এমবিএ করা স্বরূপা আখতার চাকরি খুঁজছিলেন বেসরকারি ব্যাংকে। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পরিচয় হয় নাহিদুজ্জামান রানা নামের এক সুদর্শন তরুণের সঙ্গে। রানা নিজেকে একটি বেসরকারি ব্যাংকের বড় অফিসার পরিচয় দেন। স্বরূপার বিশ্বস্ততা অর্জনে ভিজিটিং কার্ডও দেন। একপর্যায়ে স্বরূপার সঙ্গে প্রেম, প্রণয়। ঘর বাঁধার স্বপ্ন। এক সন্তানের জননী স্বরূপাকে স্বামী-সংসার ছেড়ে আসতে উৎসাহ দেন রানা।
সরল বিশ্বাসে স্বরূপা স্বামীকে ডিভোর্স দেন। এরপর ব্যাংকে অফিসার পদে চাকরির নামে রানা তার কাছ থেকে হাতিয়ে নেন ৮ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। চাকরি এবং বিয়ে কোনোটাই যখন হয়ে উঠছিল না, তখন স্বরূপা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন রানা ব্যাংকের কেউ না। এরপর থেকেই রানা স্বরূপার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। পরে আদালতে মামলা করলে তদন্ত করে এর সত্যতা পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এমন নানা ঘটনা অহরহ ঘটছে। দিনে দিনে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে অনলাইন প্রতারণা। প্রতারকদের লোভের ফাঁদে পড়ে কেউ হারাচ্ছেন সংসার, কেউ জীবনের সর্বস্ব।
চলতি বছরের ৪ মাসে ৩৫৫ প্রতারককে গ্রেফতার করেছে র্যাব। আর গত বছর গ্রেফতার করা হয়েছিল ৭৩৯ জনকে। যাদের অধিকাংশই অনলাইন প্রতারক। এছাড়া সিআইডি, ডিবিসহ পুলিশের বিভিন্ন সংস্থা প্রতারণা রোধে কাজ করছে। তবুও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না অনলাইন প্রতারণা।
নানা ধরনের প্রতারণা চলছে অনলাইনে। কেনাকাটা, চাকরি, ডলার ও সম্পর্কসহ নানা ধরনের ফাঁদ পাতছে সংঘবদ্ধ চক্র। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুককে প্রতারণার টার্গেট হিসাবে বেশি ব্যবহার করছে সঙ্ঘবদ্ধ চক্র। দেশি প্রতারকরদের সঙ্গে যোগসাজশ করে এ দেশে অবৈধভাবে বসবাস করা বিদেশিদের বড় একটি অংশ প্রতারণায় নেমেছে। এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে অবৈধ বিদেশির সংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার। তাদের মধ্যে কারাগারে রয়েছেন ৯০০। কারাগারে থাকা অধিকাংশই প্রতারণার মামলায় আটক।
এদিকে ডলার প্রতারকের খপ্পরে পড়ে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী ভাইয়ের তিলে তিলে জমানো সাড়ে তিন লাখ টাকা খুইয়েছেন একটি টেক্সটাইল মিলের কর্মী জহির। জহির জানান, গত বছরের এপ্রিলে ‘গণেশ কে’ নামে একজনের সঙ্গে তার ফেসবুকে পরিচয় হয়। ‘গণেশ কে’ নিজেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা পরিচয় দেন। তিনি বাংলাদেশে একটি হাসপাতাল করার করার প্রস্তাব দিয়ে বলেন, এতে সহযোগিতা করলে ওই প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের ৩০ শতাংশ জহিরকে দেওয়া হবে। তার লোভের টোপে পড়েন জহির। ওই বছরের মে মাসে কাস্টমস কর্মকর্তা সেজে একজন জানান, তার নামে আমেরিকা থেকে একটি পার্সেল এসেছে। পার্সেল পাঠানোর খরচ এবং পার্সেলে ডলার আছে, এমন ভয় দেখিয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর আরও টাকা দাবি করে হুমকি দিলে জহির বুঝতে পারেন প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন। এ দুটি ঘটনাই নয়, অনলাইন প্রতারণার ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে।
২০ এপ্রিল বিদেশি একটি অপরাধ চক্রের ১০ সদস্যকে রাজধানীর পল্লবী এলাকা থেকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। এ চক্রের হোতা আফ্রিকান নাগরিক হেনরি ওচিতা ওকোচোকো। বিদেশি বন্ধু সেজে উপহারের ফাঁদ পেতে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অপরাধে দুই বছর আগে সিআইডির হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন হেনরি। কয়েক মাস পর জামিনে বেরিয়ে এসে আবার শুরু করেন প্রতারণা। কয়েক মাসের জন্য বাংলাদেশে এলেও হেনরি চার বছর ধরে রয়েছেন এ দেশেই। তার সঙ্গে গ্রেফতারদের কেউ পড়ানোর ও কাজের কথা বলে, আবার কেউ ফুটবলার বা পর্যটক হয়ে এ দেশে এসে জড়িয়ে পড়েন প্রতারণায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শর্টকাটে লাভবান হওয়ার লোভকেই টোপ হিসাবে ব্যবহার করছে সংঘবদ্ধ চক্র। প্রতারণা থেকে বাঁচতে হলে এ লোভ পরিহার করতে হবে।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, কোনো আসামির জামিন আটকিয়ে রাখতে হলে মামলায় পুলিশকেই ঠিকমতো তথ্য-উপাত্ত দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, যারা প্রতারণার শিকার হন তারা খোয়া যাওয়া অর্থের বড় অংশই ফেরত পান না। কারণ প্রতারকরা এসব টাকা বিভিন্নভাবে খরচ করে ফেলে, যা আর উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। এ কারণে ভুক্তভোগী এক সময় মামলায় সাক্ষ্য দিতেও অনীহা প্রকাশ করেন। এ সুযোগে রায় অনেক সময় প্রতারকের পক্ষে চলে যায়। শর্টকাট পথে লাভবান হওয়ার লোভ যারা বেশি করে, তারাই প্রতারণার শিকার হন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার যুগান্তরকে বলেন, প্রতিনিয়ত আমরা নানা ধরনের অনলাইন প্রতারণার অভিযোগ পেয়ে থাকি। কয়েক মাসে প্রতারকদের বেশ কয়েকটি চক্রকে আমরা আইনের আওতায় এনেছি। ‘নিজস্ব সাইবার মনিটরিং সেলের মাধ্যমে বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে মনিটর করা হয়।’ তিনি বলেন, প্রতারণা পুলিশের একার পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষকে এ বিষয়ে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। লোভ পরিহার করতে হবে। প্রতারিত হলে সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করতে হবে।
আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ যুগান্তরকে বলেন, প্রতারণা প্রতিরোধে ফৌজদারি আইন রয়েছে। এছাড়া অনলাইন প্রতারণার বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের একটি সেকশন রয়েছে। তবে এ সংজ্ঞা পূর্ণাঙ্গ নয়। এ আইনের মাধ্যমে অনলাইন প্রতারকদের শাস্তি নিশ্চিত করা অনেক কঠিন। তাই আইনের এ সংজ্ঞাকে আরও একটু সংশোধন করতে হবে। যাতে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এ ধরনের প্রতারকদের ফাঁদে বেশি পড়েন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাদের বেশিরভাগ ছোট ছোট প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। ঝামেলার ভয়ে তারা আইনের আশ্রয়ও নিতে আগ্রহী হন না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপর সূত্র বলছে, শুধু রাজধানীতেই শতাধিক প্রতারক চক্র সক্রিয় রয়েছে। সাইবার দুনিয়ায় বিশাল পরিসর। যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর খুঁটে খুঁটে নজরদারি করা সম্ভব নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী প্রতিকার পেলেও অধিকাংশ ঘটনাই থেকে যায় আড়ালে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক আ ন ম ইমরান খান যুগান্তরকে জানান, র্যাব গত চার মাসে ১৭১টি অভিযানে ৩৫৫ জন প্রতারককে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৩৮টি অভিযানে ৭০ জন গ্রেফতার, ফেব্রুয়ারিতে ৫০টি অভিযানে ৯৩ জন, মার্চ মাসে ৪৪টি অভিযানে ১২৬ জন এবং এপ্রিল মাসে ৩৯টি অভিযানে ৬৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ ব্যাপারে ১৬১টি মামলা হয়েছে। ২০২১ সালে র্যাব প্রতারণার দায়ে ৭৩৯ জনকে গ্রেফতার করেছে। আর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৪ হাজার ৫২৮ জন প্রতারককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি জানান, গ্রেফতারদের মধ্যে অনলাইন প্রতারক বেশি।