পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগী সেই ছাত্রী। তবে সেখানে না ভর্তি হয়ে বুকভরা আশা আর স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ইবিতে।
ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগে ভর্তি হওয়া এই ছাত্রী ভর্তির পর পরই দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ৩০৬নং কক্ষে অতিথি হিসেবে ওঠে। তবে হলে ওঠার পর পরই হল নেত্রীকে না জানানোয় হুমকির শিকার হন। এর পর ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি দুই দফায় ‘অমানবিক’ নির্যাতনের শিকার হন। এর পরই বাধ্য হয়ে হল ছেড়ে ‘গোপনে’ পালিয়ে যান তিনি।
পরে আবার ১৪ ফেব্রুয়ারি বাবা ও মামাকে নিয়ে ফিরে আসেন ক্যাম্পাসে লিখিত অভিযোগ করতে। প্রথমে ওই ছাত্রী লজ্জায় ও ভয়ে ইতস্তত এবং শঙ্কিত হলেও রিকশাচালক বাবার অভয় পেয়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া এই ছাত্রী গণমাধ্যমেরও মুখোমুখি হচ্ছেন অকপটে। বর্ণনা করেন সেই রাতের ভয়াবহ নির্যাতনের গল্প, যা মুহূর্তেই দেশব্যাপী আলোচিত হয়, প্রত্যেক মিডিয়ায় টকশোর টপিক হয়ে যায় ‘ইবির ছাত্রী নির্যাতন’।
ওই ছাত্রী জানান, বাড়িতে ফিরে ঘটনা খুলে বলেন পরিবারের সদস্যদের কাছে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক লোকলজ্জার ভয়ে ঘটনা বাইরে জানাতে চাননি তারা। কিন্তু রিকশাচালক বাবা মেয়ের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এমন নির্যাতনের সব কাহিনি জেনে চুপ থাকতে রাজি হননি।
১৪ ফেব্রুয়ারি তার লিখিত অভিযোগ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, নির্যাতনকারীদের নেতৃত্ব দেন শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা। নির্যাতনকারী হিসেবে আরও যাদের নাম উল্লেখ করেছেন তারা হলেন— ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের তাবাসসুম ইসলাম, একই বর্ষের আইন বিভাগের ইসরাত জাহান মীম, চারুকলা বিভাগের হালিমা খাতুন উর্মী, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের মোয়াবিয়া জাহান।
অভিযুক্তরা তাকে ঘিরে ধরে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতে থাকেন। গামছা দিয়ে মুখ বেঁধে শরীরের বিভিন্ন স্থানে পিন ফোটানো, সজোরে মুখে চড়-থাপ্পড়, আপত্তিকর অবস্থায় ভিডিও ধারণ, নাম প্রকাশ করলে ভাইরালের হুমকি, প্রভোস্টের নামে কুরুচিপূর্ণ গালাগাল করতে বাধ্য করে ভিডিও ধারণ, ডাইনিংয়ের ময়লা গ্লাস চেটে পরিষ্কার করাতে বাধ্য করানো ছাড়াও অপ্রকাশযোগ্য মানসিক, শারীরিক ও যৌন হয়রানি করার মতো ঘটনা ঘটে ওই রাতে। এমনটি বর্ণনা দিয়েছেন ভুক্তভোগী ছাত্রী।
এসব ঘটনায় ওই ছাত্রী ভয় পেয়ে যান। তবে তাকে সাহস জোগান রিকশাচালক বাবা আতাউর রহমান। এসব বিষয়ে কথা হয় যুগান্তরের সঙ্গে।
ওই ছাত্রী যুগান্তরকে জানান, আতাউর রহমানের তিন মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে ভুক্তভোগী তৃতীয়। বড় ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। বড় মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন। রিকশা চালিয়ে অনেক কষ্ট করে প্রতিটা সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন তিনি। ছোট মেয়েটা ক্লাস টেনে পড়ে। তিনি সন্তানদের কখনো কারও কাছে মাথা নত করার শিক্ষা দেননি বলে জানিয়েছেন তার মেয়ে।
ভুক্তভোগী যুগান্তরকে বলেন, আমাদের বাবা-মা হয়তো আমাদের ঠিকমতো খেতে দিতে পারে না, ঠিকমতো পোশাক পরাতে পারে না। কিন্তু তারা আমাদের সবসময় সাহসী, প্রতিবাদী, সত্যবাদী ও সৎ হতে শিখিয়েছেন।
এমন নির্যাতনের ঘটনা বিভিন্ন সময় ঘটলেও তা প্রকাশ্যে আনতে সাহস করেনি ভুক্তভোগীরা। তবে ঘটনা প্রকাশ্যে আনার পর কিছুটা শঙ্কাও কাজ করছে ভুক্তভোগী পরিবাবের। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার শুরুতেই সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে মনস্তাত্তিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন ভুক্তভোগী। তার এ সাহসী প্রতিবাদ এখন সরব থাকলেও অদূর ভবিষ্যতে কি হতে পারে তা নিয়েও ভাবনার শেষ নেই পরিবারের। তবে সবাইকে অন্যায়ের এ প্রতিবাদে পাশে পাবেন বলে আশাবাদী ভুক্তভোগী পরিবারের।
এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. রেবা মন্ডল বলেন, আমরা তদন্ত সাপেক্ষে বিভিন্ন অফিস ও জায়গায় চিঠি দিয়েছি এবং উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছি। সরেজমিন তদন্তের জন্য আমরা হলে গিয়েছিলাম। মেয়েটি যে যে রুমে ছিলেন, সেসব রুমে আমরা সরেজমিন গেছি। আমরা ওই রুমে যাদের পেয়েছি, তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। আর যাদের পাইনি, তাদেরও সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে আমরা এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।