আজ শনিবার (৬ মে) আনুষ্ঠানিকভাবে অভিষেক হচ্ছে ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লসের। এর মধ্যদিয়ে মা দ্বিতীয় এলিজাবেথের উত্তরসূরী হিসেবে ব্রিটিশ সিংহাসনে বসছেন তিনি।
২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর, ব্রিটেনজুড়ে স্থানীয় সময় সকাল থেকেই আশঙ্কার মেঘ। রানীর স্বাস্থ্য নিয়ে রাজপ্রাসাদের বিবৃতিতে উদ্বেগ চারদিকে। বিকাল গড়াতেই খবর এল ‘দ্য লন্ডন ব্রিজ ইজ ডাউন।’ বিশেষ এই কোডের অর্থ রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ আর নেই। এর সঙ্গেই সমাপ্তি ঘটে একটি অধ্যায়ের, থেমে যায় একটি ইতিহাস।
তার মৃত্যুর পরই রাজা ঘোষণা করা হয় তৃতীয় চার্লসকে। রানীর মৃত্যুর দীর্ঘ আট মাস পর অবশেষে মা দ্বিতীয় এলিজাবেথের উত্তরসূরী হিসেবে ব্রিটিশ সিংহাসনে বসছেন তিনি। শুধু ব্রিটেন নয়, সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ বা কমনওয়েলথভুক্ত আরও ১৪টি দেশের রাজা হচ্ছেন চার্লস।
শনিবার বর্ণাঢ্য রাজ্যাভিষেক হবে তার। এরই মধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। সাজসজ্জা, ধর্মীয় রীতির পাশাপাশি রাজকীয় বাহিনীর মহড়ায় অংশ নিয়েছে হাজারো সৈন্য। নতুন রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান উপলক্ষে ঐতিহাসিক প্যারেডে অংশ নেবেন নৌ, বিমান ও সেনাবাহিনীর কয়েক হাজার সদস্য। রাইফেল, তলোয়ার, পতাকা হাতে মহড়ায় অংশ নিয়েছে তারা। কমনওয়েলথভুক্ত নিউজিল্যান্ড, ব্রুনাই, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকেও এসেছে সেনারা।
ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে আনা হয়েছে পবিত্র পাথর হিসেবে পরিচিত ‘স্টোন অব ডেসটিনি’। এর ওপরই রাখা হয়েছে রাজার মুকুট। সংস্কারের পর পুরোপুরি তৈরি রাজকীয় আসন। রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে চার্লস ও ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের প্রতিকৃতি খোদাই করা ৫০ পেন্স ও ৫ পাউন্ডের নতুন মুদ্রা তৈরি করেছে রয়্যাল মিন্ট। এছাড়া রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে রাজা তৃতীয় চার্লস ও কুইন কনসোর্টের নাম অঙ্কিত চীনামাটির বিশেষ মগ ও রাজমুকুটের বিশেষ রাজকীয় ইমোজি তৈরি করা হয়েছে। রাজ্যাভিষেকের সময় চার্লসকে অভিষিক্ত করতে জেরুজালেম থেকে আনা বিশেষ সুগন্ধি জলপাইয়ের তেল ব্যবহৃত হবে।
৭৪ বছর বয়সী রাজার শপথ গ্রহণের আয়োজনে উপস্থিত থাকবেন আমন্ত্রিত দুই হাজার অতিথি। সে তালিকায় রাজপরিবারের সদস্যরা ছাড়াও থাকবেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা।
রাজকীয় আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছে বাকিংহাম প্যালেস। ইতিহাসের সাক্ষী হতে প্রাসাদের সামনে ভিড় করছে রাজ পরিবারের ভক্তরাও। তাঁবু, ফোল্ডাবেল বেড, ব্যাগ, খাবারদাবার নিয়ে তারা বসে পড়েছেন প্রাসাদের কাছাকাছি।
রাজকীয় এ আয়োজনে কত খরচ হবে? কারা বহন করবে এত টাকার ব্যয়ভার?
২০১৯ সাল থেকে যুক্তরাজ্যের জিডিপি কমেছে দশমিক ৬ শতাংশ। জি সেভেনভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তারাই কেবল কোভিডের ধাক্কা এখনও সামলে উঠতে পারেনি। দেশটির মূদ্রাস্ফীতিতেও চলছে ধারাবাহিক ঊর্ধ্বগতি। গত মার্চে দেশটির বার্ষিক মূদ্রাস্ফীতির হার হিসাব করা হয়েছে ১০ দশমিক ১ শতাংশ। এই মুহূর্তে দেশটি গত ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হারে খাদ্য ও পানীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি দেখছে।
অবশ্য রাজা চার্লস আগেই বলেছিলেন, এই অনুষ্ঠান হবে সীমিত খরচে। অনুষ্ঠানে বেশি জোর দেওয়া হবে প্রতিনিধিত্বশীলতায়। রাজা বলছেন, ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের এ অনুষ্ঠানে অতিথি করা হবে মাত্র ২ হাজার ভিআইপিকে। এ সংখ্যা এর আগের রাজ্যাভিষেকে আমন্ত্রিতদের চার ভাগের এক ভাগ। তাছাড়া অনুষ্ঠানটি হবে মাত্র এক ঘণ্টার।
এক প্রতিবেদনে সিএনবিসি বলেছে, তারা অনুষ্ঠানের খরচ নিয়ে জানতে বাকিংহাম প্যালেসে যোগাযোগ করলেও তাতে কোনো সাড়া মেলেনি। বিবিসির খবরে জানানো হয়েছে, উইন্ডসর গার্ডেনে রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে একটি প্যারেড এবং একটি তারকাবহুল কনসার্টেই খরচ হবে ৬৫০ থেকে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। অধিকাংশ সরকারি আয়োজনের মতো এই অনুষ্ঠানেরও মূল খরচ হবে সরকারি কোষাগার ও অর্জিত রাজস্ব থেকে। তবে এ আয়োজনে একটি অংশ শেয়ার করবে বাকিংহাম প্যালেসও।
এই আয়োজনে সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ ব্যয় করা উচিত কিনা তা নিয়ে একটি জরিপ হয়েছে। জরিপে ৫১ শতাংশ মানুষই বলেছে, সরকারি টাকা ব্যয় করা উচিত নয়। ৩১ শতাংশ মানুষ সরকারি অর্থ ব্যয়ের পক্ষে। আর বাকি ১৮ শতাংশের কোনও মতামত নেই।
পুরো আয়োজনে ব্যয়ের পাশাপাশি ৮ মে একদিনের অতিরিক্ত সরকারি ছুটিতে অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতায়ও প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। বলা হচ্ছে, একদিনের ছুটিতে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার উৎপাদনশীলতা ব্যহত হবে।
তবে ব্রিটেন সরকার বলছে, এ অনুষ্ঠান দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে, বিশেষ করে পর্যটন এবং পরিষেবা খাতে। কোনও কোনও হিসাবের বরাতে বলা হচ্ছে, ছুটির দিনে অর্থনৈতিক ক্ষতি তো হয়ই না, বরং দিনে খুচরা লেনদেন অন্যান্য দিনের তুলনায় অন্তত ১৫ শতাংশ বেড়ে যায়।
কোনও কোনও সংবাদমাধ্যম বলছে, রাজ্যাভিষেকের এ আয়োজন উপলক্ষে সপ্তাহান্তে ব্রিটিশ অর্থনীতির আকার বাড়বে অন্তত ১ লাখ কোটি টাকা। জনগণ অন্যান্য সময়ের চেয়ে কেনাকাটায় প্রায় ২২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা বেশি ব্যয় করবেন। জনপ্রতি খরচ হবে ১১ হাজার টাকার বেশি। এ খরচের সিংহভাগ হবে সুপারমার্কেটে এবং গলির ছোট ছোট দোকানগুলোকে কেন্দ্র করে। এছাড়া রাজ্যাভিষেকের সাজসজ্জা উপলক্ষেও বিভিন্ন দ্রব্য বিক্রি হতে শুরু করেছে।
সাধারণত সপ্তাহান্তে ব্রিটির নাগরিকরা ৬৩ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা ব্যয় করে। তবে এবার এ উৎসব উপলক্ষে তারা অতিরিক্ত ৪২ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করবে।
আশা করা হচ্ছে অন্তত ২৩ লাখ মানুষ ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনে নামবে। এর পাশাপাশি ১ লাখ ২৫ হাজার বিদেশি দর্শকও থাকবে রাজপথে। এর ফলে পর্যটন খাতে বাড়তি বাণিজ্য হবে ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের।
এছাড়া উৎসব উপলক্ষে বিক্রি হবে ৩৫ লাখের বেশি বিয়ার, ৫০ লাখ বোতল ওয়াইন এবং ২ লাখ বোতল ব্রিটিশ ক্লাসিক মদ। ব্রিটিশ বিয়ার অ্যান্ড পাব অ্যাসোসিয়েশনের (বিবিপিএ) পরিসংখ্যান অনুসারে, এটি ব্রিটেনজুড়ে ১ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকার বাণিজ্য বাড়াবে। আর রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে মদের দোকানগুলোও খোলা রাখা হবে বাড়তি সময় পর্যন্ত। সূত্র: সিএনবিসি, ইউরো নিউজ, হ্যালো ম্যাগাজিন, এলবিসি, বিবিসি, টাইম আউট