চট্টগ্রামে নওরোজ এন্টারপ্রাইজের একটি চটপটির দোকান ও দুটি রেস্তোরাঁ রয়েছে। এই তিনটি ব্যবসার বিপরীতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের তিনটি শাখার দেনা ২৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইট অ্যান্ড ট্রিট নামের চটপটির দোকানটি নগরীর আসকার দীঘির পাড়ে। এর পাশেই ফিউশন ইটস নামের একটি রেস্তোরাঁ। আর লা এরিস্টোক্রেসি নামের অপর রেস্তোরাঁটি তিনবার জায়গা বদল করে এখন নগরীর আগ্রাবাদে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক নাজমি নওরোজ।
অভিযোগ রয়েছে, সামান্য ব্যবসার বিপরীতে এত বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়া সম্ভব হয়েছে খোদ ব্যাংক মালিকের বিশেষ আগ্রহে। ফলে ঋণ শোধ না করে দিব্যি বিলাসী জীবনযাপন চালিয়ে আসছেন তিনি। এ ছাড়া ঋণ শোধ না করে তিনি ব্যাংক কর্মকর্তাদের খুশি রাখতেন ‘জোরপূর্বক উপহার’ দিয়ে। ব্যাংকের মালিকপক্ষও ঋণ পরিশোধ না করার সুবিধাটি অব্যাহত রাখতে তা খেলাপি না দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অশ্রেণিবদ্ধ (আনক্লাসিফায়েড) করে রাখে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লা এরিস্টোক্রেসি রেস্তোরাঁটির নামে ২ কোটি টাকার ঋণসীমা নেওয়ার সুযোগ থাকলেও নাজমি নওরোজ উত্তোলন করেছেন ৭০ কোটি টাকা, যা সুদ-আসলে ১১৭ কোটি টাকা হয়েছে। তিনি এই টাকা নিয়েছেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের আসকার দিঘীর পাড়ের মহিলা শাখা থেকে। একই প্রতিষ্ঠানের নামে নগরীর প্রবর্তক মোড়ে অবস্থিত ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক শাখা থেকে তিনি ঋণ নেন ৫৪ কোটি টাকা, যা সুদে-আসলে এরই মধ্যে ৯০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা হয়েছে। এর বাইরে ব্যাংকটির চকবাজার শাখা থেকে ২৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। তবে চকবাজার শাখার পুরো টাকা এস এলম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যাংকটির মালিক সাইফুল আলম মাসুদ নিয়ে নিয়েছেন বলে দাবি করেছেন নাজমি নওরোজ।
আসকার দিঘীর পাড়ের মহিলা শাখার মাধ্যমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে ২০১১ সাল থেকে লেনদেনের শুরু হয় নাজমি নওরোজের। বর্তমানে এই ঋণ সুদে আসলে ১১৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ব্যাংকের চাপাচাপিতে ২০২২ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনি শুধুমাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। তবে ঋণের টাকা অশ্রেণিবদ্ধ (আনক্লাসিফায়েড) তালিকায় দেখানো হয়। ব্যাংক সূত্র জানায়, মালিকপক্ষ চায়নি বলে নাজমি নওরোজকে ঋণ খেলাপি হিসেবে দেখানো হয়নি। তাই ঋণটিকে অশ্রেণিবদ্ধ করে রাখা হয়। অবশেষে গত আগস্ট মাসে তাকে ঋণ খেলাপি হিসেবে দেখানো হয় এবং পাওনা আদায়ে মামলা করা হয়।
ব্যাংক সূত্র জানায়, নাজমি নওরোজ ব্যাংক থেকে যে টাকা উত্তোলন করেন, বছর শেষে তা পরিশোধ না হওয়ায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে কোনো কথা বলেনি। তবে ব্যাংকের টাকা ফেরত না পাওয়ায় শাস্তি হিসেবে আটকে দেওয়া হয় একাধিক কর্মকর্তার পদোন্নতি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংকটির এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, নাজমি নওরোজ ব্যাংকের কিস্তি জমা দেন না। কিন্তু মাঝেমধ্যে উপহার নিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের কাছে আসেন। কর্মকর্তারা এসব উপহার গ্রহণ করতে না চাইলে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দিয়ে প্রচ-ভাবে ধমকাতেন।
এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যাংক থেকে তুলতে পারার জন্য নাজমি নওরোজ পুরো দায় চাপিয়েছেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ ও তার ব্যক্তিগত সহকারী আকিজ উদ্দিনের ওপর। সাইফুল আলম মাসুদ এ ব্যাংকের চেয়ারম্যান। নাজমি নওরোজ আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমি যে পরিমাণ সম্পদ ব্যাংকে জামানত দিয়েছি তাতে ৪০ কোটি টাকাও পাওয়ার কথা নয়। যা কিছু হয়েছে সবই মাসুদ সাহেবের ইচ্ছায় হয়েছে। আমি যে আকিজ উদ্দিনকে টাকা দিয়েছি, সেই প্রমাণ আমার কাছে আছে। ব্যাংকের নতুন পর্ষদ গত রবিবার আমার সঙ্গে বসেছে। আমি তাদেরকে এসব জানিয়েছি।’
তাহলে ব্যাংকের এত টাকার দায় দেনা কে পরিশোধ করবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে নাজমি নওরোজ বলেন, ‘কেন? মাসুদ সাহেব শোধ করবেন?’ নাজমি নওরোজ উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘টাকা জামানত ছাড়া আমি এত বিপুল পরিমাণ টাকা কীভাবে তুলতে পারলাম? পারলাম ওই ব্যাংকের মালিক মাসুদ সাহেবের ইচ্ছায়।’
ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ ও তার ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) আকিজ উদ্দিনের বিশেষ আগ্রহে সামান্য চটপটির দোকান ও রেস্তোরাঁর নামে নাজমি নওরোজ এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যাংক থেকে তোলার সুযোগটি পান।
গতকাল সোমবার দুপুরে নগরীর সাইফুদ্দিন খালেদ সড়কে অবস্থিত ফিউশন ইট নামের রেস্তোরাঁয় বসে কথা হয় এর মালিক নাজমি নওরোজের সঙ্গে। আপনার চটপটির দোকান ও রেস্তোরাঁর বছরে আয় কত? ব্যক্তিগত চলাফেরার গাড়ির দাম ও বিদেশে সন্তানদের লেখাপড়া সংক্রান্ত আরও কয়েকটি প্রশ্নের জবাব চাইলে তিনি এড়িয়ে যান। বন্দরে যাচ্ছি জরুরি কাজ আছে- এই কথা বলে দ্রুত কেটে পড়েন তিনি।
যেভাবে ব্যবসা শুরু : নাজমি নওরোজ ২০১২ সালে ৮১, শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ রোড ঠিকানায় লা এরিস্টোক্রেসি নামে একটি রেস্তোরাঁর ব্যবসা শুরু করেন। এখানে কম-বেশি ১০০ জনের বসার ব্যবস্থা ছিল। ২০২০ সালে হঠাৎ লা এরিস্টোক্রেসি নামের রেস্তোরাঁটি সেখান থেকে সরিয়ে প্রথমে শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ রোডের কর্ণফুলী টাওয়ারে (এস আলম টাওয়ার) এবং পরে নগরীর আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার ১০৫ হোসাইন চেম্বারের নিচতলায় স্থানান্তর করেন। আর লা এরিস্টোক্রেসি হোটেলটির নতুন নাম দেন ফিউশন ইট। দামপাড়া পুলিশ লাইনের কাছে কেক বিক্রিরও একটি দোকান তিনি খুলেছিলেন, যেটি এখন নেই। নগরীর একমাত্র পাঁচতারা হোটেল রেডিসন ব্লু’র প্রবেশপথের বিপরীত পাশেও তিনি ইট অ্যান্ড ট্রিট নামের একটি চটপটির দোকান খুলেন। কয়েক মাসের মধ্যে বন্ধও করে দেন।
এভাবে নানা জায়গায় বারবার দোকান খোলা এবং বন্ধ করার কারণ জানতে চাইলে ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা দিয়েছেন চাঞ্চল্যকর তথ্য। তারা বলেছেন, লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে ব্যাংক থেকে অধিক হারে ঋণ বরাদ্দের জন্য তিনি এই কৌশল নেন। অর্থের উৎস গোপন করা হয় এই প্রক্রিয়ায়। যেমন একটি ব্যাংক হিসাব থেকে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে অর্থ স্থানান্তর, বিদেশে অর্থ পাচার, ট্রাভেলার্স চেকে রূপান্তর, একটি ব্যাংক হিসাব থেকে অন্যান্য শাখায় বিভিন্ন নামে অর্থ সরানোর জন্য এই কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়। নাজমি নওরোজ রেস্তোরাঁ ব্যবসায় আয় উন্নতি যা-ই হোক না কেন, তিনি বারবার শাখা বাড়ানো বা নাম পরিবর্তন করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় প্রতিষ্ঠান স্থানান্তরের কূট কৌশলের আশ্রয় নেন।
একটি ভাতের হোটেল এবং একটি চটপটির দোকানে বিক্রি-বাট্টা কত- তা নিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের রয়েছে প্রশ্ন। তবে নাজমি নওরোজের বিলাসী জীবনের সঙ্গে এই দুইটি দোকান মেলানো অসম্ভব। তার নিজস্ব চলাফেরার জন্য আছে একটি টয়োটা ক্রাউন সেডান কার। নগরীর অভিজাত এলাকা নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটিতে আছে দুটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টম্যাটে। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে লেখাপড়া করিয়েছেন লন্ডন ও কানাডায়।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক প্রধান (উত্তর) মো. হাফিজুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, নাজমি নওরোজের বিরুদ্ধে আমরা আদালতে মামলা করেছি। ঋণের টাকা আদায়ের সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত আছে।