দেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হলেও তা ঠেকানো এবং পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ খুব সামান্য। আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে বিভিন্ন দেশ থেকে মাত্র ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ফেরাতে ৫৯টি মামলা হয়েছে।
গত সরকারের আমলে প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তির বিষয়ে বেশ আগে থেকে পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। অনেক মামলার টার্গেট ছিল বিএনপি নেতারা। অবশ্য সরকার পরিবর্তনের পর সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদসহ সাবেক কয়েকজন মন্ত্রী-এমপি এবং প্রভাবশালী কয়েকজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে সরব হয়েছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা। বিগত সরকারের সময়ে বিভিন্ন দেশের কাছে ৭৫টি মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) বা আইনি সহায়তার আবেদন করা হলেও একটিরও জবাব মেলেনি।
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) গত বছরের জানুয়ারিতে উচ্চ আদালতে অর্থ পাচার, উদ্ধার প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে ৪৯ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট দাখিল করে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করে নেওয়া বিশেষ গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছেন। এর বাইরে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, হংকং, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, কুয়েত, গার্নসি, বেলজিয়াম, তানজানিয়ায় পাচারের তথ্য রয়েছে। এসব দেশে পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে সব মিলিয়ে ৫৯টি মামলার চার্জশিট হয়েছে। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ৪৭ মামলায় ১ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ করেছে। এর বিপরীতে এখন পর্যন্ত ৫১টি এমএলএআর করেও কোনো সাড়া মেলেনি। আর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ ১০টি মামলায় ১ হাজার ১১৪ কোটি টাকা পাচারের চার্জশিট দিয়েছে। এর বিপরীতে ১৪টি এমএলএআর করে একটিরও সাড়া পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া এনবিআরের কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (সিআইআইডি) ভারতে ৬৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা পাচারে একটি এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) যুক্তরাষ্ট্রে ৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা পাচারে একটি মামলা করেছে। এ ক্ষেত্রেও এমএলএআর করেও জবাব মেলেনি।
বিএফআইইউ মনে করে, পাচার করা অর্থ উদ্ধার অনেক জটিল। যে কারণে বিশ্বব্যাপী এখন ‘অ্যাসেট রিকোভারি’ বা সম্পদ উদ্ধারের চেয়ে ফাঁকি দেওয়া কর আদায় তথা ‘ট্যাক্স রিকোভারি’ প্রক্রিয়ার ওপর বেশি জোর দিচ্ছে। বাংলাদেশ গত বছর এ সুবিধা দিলেও তাতে সাড়া মেলেনি। মূলত পাচারকারী অনেকেই সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাদের নিয়ে কোনো নাড়াচাড়াও ছিল না। বিএফআইইউ প্রধানত অর্থ পাচার প্রতিরোধ এবং দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে প্রাথমিক তথ্য আদান-প্রদান করে। অন্যদিকে, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অর্থ পাচার বিষয়ে মামলার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) দায়িত্বপ্রাপ্ত।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পাচার হওয়া অর্থ ফেরতে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ একটি মাত্র কেসে সফল হয়েছে। ২০১২-১৩ সময়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর সিঙ্গাপুর থেকে ৩০ লাখ ডলার ফেরত আনা সম্ভব হয়। এটা সম্ভব হয়েছিল সব সংস্থার সম্মিলিত উদ্যোগের ফলে। তৎকালীন সরকারের এমন মনোভাব ছিল, প্রয়োজনে ৩০ লাখ ডলার ফেরানোর জন্য এর চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে একটি উদাহরণ সৃষ্টি করবে। তারা জানান, কোকোর টাকা ফেরত আনার পর তৎকালীন সরকার ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছিল, যা আন্তর্জাতিক নিয়মের বিরোধী। আবার যেসব মামলা হয়েছে, তার বেশির ভাগই রাজনৈতিক নেতা কিংবা বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। যে কারণে এমএলএআরের একটিরও জবাব পাওয়া যায়নি। এমএলএআরের জবাব না পেলে পরবর্তী ধাপে যাওয়ার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের জন্য প্রথমে দেশের আদালতে প্রমাণ করতে হবে। এর পর সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে অর্থ ফেরত আনতে তৎপরতা চালাতে হবে। আর এ জন্য বিএফআইইউ, দুদক, এনবিআর, সিআইডিসহ আইন প্রয়োগকারী বা তদন্তকারী সংস্থা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। আবার দেশের বাইরেও আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগসহ লেগে থাকতে হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে এসব নিয়ে দাবি তুলতে হয়। তবে যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, এ ক্ষেত্রে তাদের আন্তরিকতার ঘাটতি দেখা যায়। যে কারণে অর্থ উদ্ধার কার্যকর হয় না। এখন একটি অরাজনৈতিক সরকার রয়েছে। ফলে তারা চাইলে উন্নতি সম্ভব।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, একবার অর্থ পাচার হলে তা ফেরত আনা অনেক দুরূহ। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা অনেক চ্যালেঞ্জিং কাজ। তবে দেশ থেকে অর্থ পাচারের প্রধান প্রধান গন্তব্যের দেশ সবার জানা। প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে এসব দেশে প্রতিনিধি পাঠিয়ে কে কোথায় কী সম্পদ গড়েছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এর পর তার দেশে থাকা সম্পত্তি ক্রোক করে অর্থ উদ্ধারের জোর চেষ্টা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে পাচার অর্থ ফেরত ও নতুন করে পাচার ঠেকানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
রাঘববোয়ালদের নাম নেই মামলায়
বিভিন্ন ব্যাংক দখল করে ঋণের নামে টাকা বের করে তা পাচারের জন্য দেশের সবচেয়ে সমালোচিত এস আলম গ্রুপ। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলমের শুধু সিঙ্গাপুরে অন্তত ১০০ কোটি ডলারে হোটেল, বাড়ি, বাণিজ্যিক স্পেস এবং বিভিন্ন সম্পদ কেনার তথ্য উঠে আসে। অথচ গত সরকারের আমলে তাঁর নামে অর্থ পাচারের কোনো মামলা করেনি সরকারি কোনো সংস্থা। এমনকি তাঁর অর্থ পাচার বিষয়ে অনুসন্ধান না করতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্দেশনা দেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের আপিল বেঞ্চ।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের তিন দেশে বিপুল সম্পদের তথ্য রয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কাছে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, জাবেদ, তাঁর স্ত্রী রুখমিলা জামান, মেয়ে জেবা জামান এবং ভাই আনিসুজ্জামানের নামে রয়েছে বিপুল সম্পদ। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৬ ফ্ল্যাট, যুক্তরাষ্ট্রে তিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ৯ ফ্ল্যাট এবং লন্ডনে ৩ হাজার কোটি টাকার আট কোম্পানি রয়েছে। এসব কোম্পানির নামে ৩৬০টি বাড়ি রয়েছে। বেশ আগেই সংস্থাটি এসব তথ্য সংগ্রহ করলেও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
আওয়ামী লীগ নেতা মো. আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপের নিউইয়র্কে ৯টি বাড়ি, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের বেলজিয়ামে বাড়িসহ বিভিন্ন সম্পদ থাকার অভিযোগ রয়েছে। সাবেক এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুলের স্ত্রী শামীমা সুলতানা জান্নাতীর নামে কানাডার টরন্টোর স্কারবোরোতে বাড়ি, সোনালী ব্যাংকের আলোচিত ঋণখেলাপি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল হান্নান রতনের কানাডায় তিনটি বাড়ি, সাদ মুসা গ্রুপের মুহাম্মদ মোহসিনের যুক্তরাষ্ট্রে বাড়িসহ সম্পদের তথ্য বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে এসেছে। এ ছাড়া বিতর্কিত ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদসহ অনেকের বিদেশে সম্পদ থাকার বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় এসেছে।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর প্রভাবশালী বিভিন্ন ব্যবসায়ী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের অর্থ পাচারের তথ্য সংগ্রহ করছে বিএফআইইউ। বিগত সরকারের সময় ফুলেফেঁপে ওঠা অনেকের বিদেশে সম্পদের তথ্য সংগ্রহের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন উপায়ে তথ্য সংগ্রহ করছে বিএফআইইউ। দ্রুততম সময়ে এসব ব্যক্তির পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা চেয়েছে সরকার। পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে এরই মধ্যে নতুন করে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।
বিরোধীদের নামে যত মামলা
১০ বছর আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার মামলা করে দুদক। ২০১৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি করা মামলায় গত ২২ আগস্ট তাঁকে খালাস দিয়েছেন আদালত। বিগত সরকারের সময়ে যুক্তরাজ্যে অর্থ পাচারের মামলা করা হয় প্রয়াত সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধে।
বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালু, এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াহিদুল হক এবং আল-আরাফাহ্ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার বিষয়ে এমএলএআর চেয়ে চিঠি দেয় দুদক। তবে একটিরও জবাব মেলেনি। আবার ক্যাসিনোকাণ্ড ফাঁসের পর বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার ৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা পাচারের বিষয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের কাছে আইনি সহায়তা চেয়েও সাড়া মেলেনি। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রে জাপান বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রিন্টিংয়ের পরিচালক সেলিম প্রধানের ১২ কোটি টাকা, অস্ট্রেলিয়ায় বিসিবির পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার ৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের ৩ কোটি টাকা ও মমিনুল হক সাঈদের ৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা পাচারের বিষয়ে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার কাছে আইনি সহায়তা চাওয়া হয়। এসব সহায়তায়ও সাড়া মেলেনি।