প্রেসিডেন্ট আসাদ পতনের মাস্টারমাইন্ড কে এই জুলানি?

Spread the love

সিরিয়ার দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ এবং সর্বশেষ সহিংসতার মাত্র ১২ দিনের মাথায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের নেপথ্যে অন্যতম কারিগর হলেন আবু মোহাম্মদ আল-জুলানি।

বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) এই নেতা কেবল সামরিক অভিযানের পরিকল্পনায় নয়, বরং বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতেও দক্ষতা দেখিয়েছেন।

আসাদ সরকারের পতন নিয়ে যখন বিশ্বজুড়ে আলোচনা চলছে, তখন জুলানির পরিচয় ও তার কৌশল নিয়ে আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে।

আবু মোহাম্মদ আল-জুলানির পরিচয়

৪২ বছর বয়সি আবু মোহাম্মদ আল-জুলানির প্রকৃত নাম আহমেদ হুসাইন আল-শারা। তিনি ১৯৮২ সালে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৭ বছর বয়সে রিয়াদ থেকে পরিবারের সঙ্গে পাড়ি জমান সিরিয়ায়।

দখলদার ইসরাইলের দখল করা গোলান মালভূমি ছিল তার পূর্ব-পুরুষদের আদিনিবাস। তার পরিবার ১৯৮৯ সালে সিরিয়ায় ফিরে আসে এবং দামেস্কের উপকণ্ঠে বসবাস শুরু করে।

তরুণ বয়সে তার জীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালালে, ওই সময় তিনি ইরাকে গিয়ে আল-কায়েদায় যোগ দেন এবং মার্কিনবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

২০০৬ সালে মার্কিন বাহিনী তাকে আটক করে এবং কারাবন্দি রাখে। পরবর্তীতে তারা তাকে সিরিয়ায় আল-কায়েদার শাখা আল-নুসরা ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার কাজ দেয়। এই গোষ্ঠীটিই মূলত সিরিয়ার বিরোধী অঞ্চলে বিশেষত ইদলিবে প্রভাব বিস্তার করে। ২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরুর সময় তিনি মুক্ত হন এবং তখন থেকেই সিরিয়ায় বিদ্রোহী আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।

গৃহযুদ্ধে ভূমিকা

২০১১ সালেই সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতনে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়। এই সুযোগে দেশটিতে আবু বকর আল বাগদাদি আল-কায়দার শাখা হিসাবে আল নুসরা ফ্রন্ট গড়ে তোলার দায়িত্ব দেন জুলানির হাতে। যা তাকে এনে দেয় ব্যাপক পরিচিতি এবং ক্ষমতা। আর এই সুযোগটি খুব ভালোভাবে ব্যবহার করেন জুলানি। সিরিয়ার ইদলিব অঞ্চলে তৈরি করেন তার বাহিনীর শক্ত অবস্থান। তার নেতৃত্বে আল নুসরা ফ্রন্ট সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।

তবে ২০১৩ সালে বাগদাদির সঙ্গে মতবিরোধ হলে জুলানি আল-নুসরা ফ্রন্টকে নতুনভাবে সংগঠিত করেন।

২০১৬ সালে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা ক্রমেই দুর্বল হতে থাকলে জুলানি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ার চেষ্টা করেন। তিনি আল-নুসরা ফ্রন্টের নাম পরিবর্তন করে জাবাহাত ফাতাহ আল-শাম রাখেন।

পরে ছোট ছোট বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে একত্রিত করে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) প্রতিষ্ঠা করেন।

আসাদ সরকারের পতনে ভূমিকা

সাম্প্রতিক সময়ের বিদ্রোহীদের অভিযানে জুলানিই ছিলেন মূল পরিকল্পনাকারী ও কৌশলবিদ। বিদ্রোহীরা প্রথমে আলেপ্পো এবং পরে হামা শহর দখল করে। এরপর ১২ দিনের মধ্যেই তারা রাজধানী দামেস্কে প্রবেশ করে এবং আসাদের শাসনের অবসান ঘটায়। এই পুরো অভিযানেই জুলানির নেতৃত্ব ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তার কৌশল ছিল বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদের একটি শক্তিশালী সামরিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে নিয়ে আসা। জুলানির পরিকল্পনা এবং নেতৃত্ব বিদ্রোহী যোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়েছে এবং আসাদের অনুগত বাহিনীর পতন ত্বরান্বিত করেছে।

এইচটিএসের শাসনব্যবস্থা

২০১৭ সালে জুলানির নেতৃত্বে ইদলিবে ‘সিরিয়ান স্যালভেশন গভর্নমেন্ট’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা কার্যত এইচটিএস-এর প্রশাসনিক শাখা। এই সরকারের অধীনে ইদলিব পরিচালিত হলেও তাদের কঠোর শাসননীতি নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা রয়েছে। বিরোধীদের দমন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

জুলানির ভবিষ্যৎ

বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ার ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা কেমন হবে, তা নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েছে। তবে জুলানি সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর একমাত্র গ্রহণযোগ্য নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তার রাজনৈতিক এবং সামরিক কৌশল কীভাবে সিরিয়ার নতুন যুগ গড়ে তুলবে, তা সময়ই বলে দেবে।

জুলানির জীবন ও নেতৃত্বের কাহিনী মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এবং সামরিক কৌশল নিয়ে আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও কার্যক্রম পুরো অঞ্চলের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে প্রভাবিত করতে পারে। সূত্র: বিবিসি ও রয়টার্স