সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানাসহ পরিবারের চার সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের বিরুদ্ধে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সাবেক সরকারের অগ্রাধিকারের ৯ প্রকল্পের ৮০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের সভাপতিত্বে জরুরি সভায় কমিশন অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দুদক মহাপরিচালক ও মুখপাত্র মো. আক্তার হোসেন নিয়মিত ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। অভিযুক্ত অন্য দু’জন হলেন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও শেখ রেহানার মেয়ে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী টিউলিপ সিদ্দিক। শেখ রেহানার বিরুদ্ধেও রয়েছে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ। বলা হচ্ছে, শেখ হাসিনার ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তিনি নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
দুদক সূত্র জানায়, শেখ হাসিনাসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে একটি বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। টিমের সদস্যরা অনুসন্ধান শেষ করে কমিশনে প্রতিবেদন পেশ করবেন। পরে কমিশন প্রতিবেদনের আলোকে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি ও দলের ছত্রছায়ায় থাকা প্রভাবশালীসহ প্রায় আড়াইশ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এরই মধ্যে কতিপয় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
দুদকে দেওয়া অভিযোগ থেকে জানা গেছে, শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয় ও টিউলিপ সিদ্দিক মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প থেকে ৫০০ কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা) লোপাট করেছেন। তারা সাবেক সরকারের সময়ে আশ্রয়ণসহ অন্য বড় প্রকল্পের অর্থও লুটেছেন ইচ্ছামতো।
সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যম গ্লোবাল ডিফেন্স করপোরেশনের তথ্য তুলে ধরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দুদক ওই সব প্রতিবেদন অভিযোগ হিসেবে আমলে নিয়ে প্রাথমিকভাবে অনুসন্ধান করেছে। তাদের অনুসন্ধানে দুর্নীতির নানা তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। পরে কমিশনে প্রথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। কমিশন ওই প্রতিবেদন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অনুসন্ধানের অনুমোদন দেয়। দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ৫০০ কোটি ডলার লোপাট করা হয়েছে।
দুদক জানায়, রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা রোসাটম মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ওই অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করেছিলেন সজীব ওয়াজেদ জয় ও টিউলিপ সিদ্দিক।
জানা গেছে, রাশিয়ার সহযোগিতায় রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার, যা প্রকৃত খরচের চেয়ে অনেক বেশি। খরচের বর্ধিত টাকাই আত্মসাৎ করা হয়। পরস্পর যোগসাজশে এই সুযোগ করে দিয়েছিল প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা রোসাটম। টিউলিপ সিদ্দিকের মধ্যস্থতায় রাশিয়ার সঙ্গে এ প্রকল্পের চুক্তি করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মধ্যস্থতার বিনিময়ে মোট ব্যয়ের ৩০ শতাংশ অর্থ পেয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক, তাঁর মা শেখ রেহানা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা।
দুদক থেকে আরও জানা যায়, ২০১৩ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে শেখ হাসিনার সাক্ষাতের সময় সঙ্গী ছিলেন টিউলিপ সিদ্দিক। গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের দাবি, সে সময় ঢাকা-মস্কোর বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তির মধ্যস্থতাও করেছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে প্রচ্ছায়া লিমিটেড নামে একটি ভুয়া কোম্পানি চালু করেন টিউলিপ সিদ্দিক, তাঁর মা শেখ রেহানা ও চাচা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক। যুক্তরাষ্ট্রেও জুমানা ইনভেস্টমেন্ট নামে একটি কোম্পানি রয়েছে তাদের।
গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের তথ্য অনুযায়ী, ওই কোম্পানির মাধ্যমেই বিভিন্ন দেশের অফশোর অ্যাকাউন্টে অর্থ পাচার করতেন শেখ হাসিনা। তাদের কোম্পানিটি এমএলএম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ডেসটিনি গ্রুপ ফান্ড কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার পাচার করে।
গত ৩ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেছিলেন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ। রিটে রূপপুর প্রকল্পের দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদকের নিষ্ক্রিয়তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। দুদক চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের রিটের বিবাদী করা হয়। রিটের শুনানি নিয়ে এসব অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে ১৫ ডিসেম্বর রুল জারি করেন হাইকোর্ট।