ভারতের যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কুশল বরণের

Spread the love

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. কুশল বরণ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস এবং উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি হাসিনা পালানোর পর বাংলাদেশে হিন্দুদের ‘গণহত্যা চলছে’ শিরোনামে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলে কনফারেন্সে গুজব ছড়িয়েছেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পদোন্নতি বোর্ডে তার নাম নিয়ে বিতর্ক হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগী আদিত্যনাথ, আরেক প্রতিমন্ত্রী রামেশ্বর তেলিজিসহ ভারতের আরএসএস ঘরনার সব মন্ত্রী-এমপির সঙ্গে বেশকিছু ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি বাংলাদেশ অখণ্ড ভারতের অংশ বানিয়ে আরএসএসের মানচিত্রের পাশে ছবি তুলে তা ফেসবুকে দেয়ার ছবিও রয়েছে তার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন, কুশল বরণ চক্রবর্তী দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের ‘সনাতনী জোট’, ‘আরএসএস’ ও ‘যোগী আদিত্যনাথ ক্যাম্প’-এর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে আসছিলেন। একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানের সময় তাকে যোগী আদিত্যনাথের কার্যালয়ে দেখা গেছে বলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি ছড়িয়েছে।

আরো অভিযোগ রয়েছে, তিনি শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ঢাকায় আয়োজিত সনাতনদের মিছিল-সমাবেশে অংশ নিয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ এবং ‘হিন্দু রাষ্ট্র গঠন চাই’ জাতীয় উগ্র হিন্দুত্ববাদী স্লোগান দেন।

বিশ্ববিদ্যালয় ও কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, তিনি সম্প্রতি ভারতের কয়েকটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী ফোরামে বক্তব্য দিয়েছেন, যেখানে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলা হয়। একাধিক ফেসবুক লাইভ, ওয়েবিনার ও ছবি ঘিরে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ তিনি ‘হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের’ স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরতে ভূমিকা রাখছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা তাহসান হাবিব আমার দেশকে বলেন, কুশল বরণ একাধিক আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বলেছেন, বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ ও পাহাড়িদের ওপর পরিকল্পিত গণহত্যা চলছে। ঢাকায় এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তা নেই এবং এ রাষ্ট্র ইসলামিক মৌলবাদীদের দ্বারা পরিচালিত।

‘জুলাই আগস্টে তিনি পোস্ট করেন, যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করছে তারা নাকি রাজাকারের বাচ্চা। শেখ হাসিনার প্রমাণিত দোসরকে যারা বাঁচাতে চাই, তারা শেখ হাসিনার বিচারকেও কয়েকদিন পর মব বলবে’ বলেন তিনি।

বৃহস্পতিবার বিকেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির সাক্ষাৎকার দিতে এসে আলোচনায় আসেন কুশল বরণ চক্রবর্তী। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে তাকে ঘিরে শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের একাংশের প্রতিবাদ ও হট্টগোলের ঘটনা ঘটে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, কুশল বরণ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি বিদেশে বসবাসরত কিছু সংখ্যালঘুবিষয়ক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়-এমন বক্তব্য বিভিন্ন সময়ে সামাজিক মাধ্যমে দিয়েছেন।

ওইদিন বিকেল ৫টার দিকে তিনি প্রশাসনিক ভবনে প্রবেশ করলে একদল ছাত্র তাকে ঘিরে ধরে স্লোগান দিতে শুরু করে। উপস্থিত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ‘এমন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতি দেওয়া মানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যবোধের সঙ্গে আপোস করা।’একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে কুশল বরণ চক্রবর্তীকে উপাচার্যের দপ্তরে আশ্রয় নিতে হয়। প্রায় দু’ঘণ্টা পর উপাচার্যের গাড়িতে করে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে যান।

তবে কুশল বরণ চক্রবর্তী বলেন, আমাকে পরিকল্পিতভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলো ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

তিনি আরো বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম মেনেই সাক্ষাৎকার দিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেখানে আমাকে বাধা দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, কুশল স্যার নিজেই শিক্ষার্থীদের ভিড়ের মধ্যে গিয়ে উত্তেজনা তৈরি করেছেন। পরে তাকে নিরাপত্তার জন্য উপাচার্যের দপ্তরে রাখা হয়।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়

গতবছর ২৬ নভেম্বর হেফাজতে ইসলামের কর্মী এনামুল হক চৌধুরী চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে চিন্ময় কৃষ্ণের অনুসারীদের হামলার শিকার হন। এ সময়ে তিনি কিরিচের কোপে মাথায় গুরুতর জখম হন এবং তার ডান হাত ভেঙে যায়। এ ঘটনায় তিনি গত ৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু বকর সিদ্দিকের আদালতে চিন্ময় কৃষ্ণকে প্রধান আসামি করে ১৬৪ জনের নামে মামলার আবেদন করেন। এই মামলার ২০ নম্বর আসামী চবির সংস্কৃত বিভাগের সহকারী এই অধ্যাপক।

এ ছাড়া গতবছর ২৬ অক্টোবর ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর গণহত্যা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন কুশল বরণ চক্রবর্তী। ভারতের প্রেসক্রিপশনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে তার গ্রেপ্তারেও দাবি জানান তারা। তাকে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সমর্থক ও র-এর এজেন্ট বলে অভিযোগ করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আহমাদ ইফতেখার বলেন, কুশল স্যার নিয়মিত ধর্মবিদ্বেষমূলক পোস্ট দেন। আমরা বারবার প্রশাসনকে জানিয়েছি, কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আজ আমরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করেছি। আমরা চাই তাঁর পদোন্নতি স্থগিত করা হোক এবং তদন্ত করা হোক।

পদোন্নতির বোর্ড বাতিল

ড. কুশল বরণ চক্রবর্তীর পদন্নোতিতে গতকাল শুক্রবার বিকেল ৩টায় বোর্ড বসার কথা এরপরই শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। আন্দোলনের মুখে বোর্ড প্রত্যাহার করে কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার দুপুর আড়াইটা থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। পরে সাড়ে ৩টায় প্রশাসনিক ভবনে তালাদেন তারা। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, দু’উপ-উপাচার্য ও কর্মকর্তারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। এ সময়ে তাদেরকে ‘বাহ! ভিসি চমৎকার, স্বৈরাচারের পাহারাদার’; ‘একটা একটা লীগ ধর, ধরে ধরে জেলে ভর’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা যায়।

এদিকে কুশল বরণ চক্রবর্তীর পদোন্নতি ঘিরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, সেখানে একদল শিক্ষার্থী ও ছাত্রসংগঠনের প্রতিবাদের কারণে তার প্রকৃত যোগ্যতা যাচাইয়ের সুযোগটাই যেন হারিয়ে গেছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি বঙ্গবন্ধু ও মুজিববর্ষ বিষয়ে যেসব প্রবন্ধ জমা দিয়েছেন, তা তার একাডেমিক ডিসিপ্লিন-সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও প্রশাসনিক সূত্র বলছে, নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতির জন্য প্রার্থীর গবেষণা, পাণ্ডিত্য এবং প্রকাশনার সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক মিল থাকা আবশ্যক। কিন্তু কুশল বরণ চক্রবর্তী সেই ন্যূনতম মানদণ্ড পূরণ করেছেন কি না, তা বোর্ডে খতিয়ে দেখার আগেই ঘটনাবহুল প্রতিবাদের ভেতর তিনি যেন একপ্রকার ‘ভিকটিম’ হিসেবে সামনে চলে এসেছেন।