বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পরিবারের ওপর নির্ভর করবে না। দলটিকে নির্বাচনে অংশ নেয়া নিষিদ্ধ করার পর, লাখ লাখ সমর্থক আগামী জাতীয় নির্বাচন বর্জন করবেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন দলটির নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ওদিকে লন্ডনের ইন্ডিপেন্ডেন্টকে আলাদাভাবে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি গত বছর ছাত্রদের নেতৃত্বে বিক্ষোভের সময় নিহতদের বিষয়ে ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, তার দলকে বাদ দিয়ে যে সরকার গঠিত হবে, এমন যেকোনো সরকারের অধীনে দেশে ফিরে আসবেন না। ভারতেই অবস্থান করবেন। গত বছর ৫ই আগস্ট পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর এবারই প্রথম বিদেশি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎকার দিলেন। তিনি পালিয়ে যাওয়ার পর শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশে নেতৃত্ব দিচ্ছে। হাসিনার অপসারণের পর থেকেই বাংলাদেশ শাসন করছেন তারা। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা শুধু অন্যায় নয়, বরং সেলফ-ডিফিটিং। তিনি বলেন, পরবর্তী সরকারে অবশ্যই নির্বাচন-তাৎপর্য থাকা চাই। কোটি কোটি মানুষ আওয়ামী লীগের সমর্থক। তাই এ অবস্থায় তারা ভোটে যাবে না। কার্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য কোটি কোটি মানুষকে নির্বাচন থেকে বঞ্চিত করা যায় না।
রয়টার্স লিখেছে, বাংলাদেশে নিবন্ধিত ভোটারের সংখ্যা সাড়ে ১২ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দীর্ঘদিন ধরেই মূল দুই দল। আগামী নির্বাচনে বিএনপিকেই বিজয়ী হিসেবে দেখা হচ্ছে। সামপ্রতিক সময়ে নির্বাচন কমিশন মে মাসে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করেছে। তার আগে ইউনূস সরকারের অধীনে জাতীয় নিরাপত্তা ও যুদ্ধাপরাধ তদন্তের জন্য ওই দলের সব কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমরা আমাদের সমর্থকদের অন্য কোনো দলকে সমর্থন করতে বলছি না। আমরা এখনো আশা করি, সাধারণ বিবেক জয়ের পথে ফিরে আসবে এবং আমাদের দল নিজে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। রয়টার্স লিখেছে- তিনি জানালেন না, নিজে কিংবা তার প্রতিনিধির মাধ্যমে তারা গোপনে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছেন কি-না, যাতে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। ইউনূস সরকারের মুখপাত্ররা এ বিষয়ে মন্তব্য করেননি। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১৫ই জুলাই থেকে ৫ই আগস্টের মধ্যে কমপক্ষে ১,৪০০ জন নিহত হয়েছেন, যা স্বাধীনতার পর থেকে দেশের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সহিংসতা ছিল। হাসিনা এই অভিযোগগুলো অস্বীকার করে বলেছেন, তিনি নিজে প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগ বা অন্যান্য অভিযোগের অপরাধে অংশ নেননি। তিনি বলেছেন, তার দেশে ফেরা এখনো পরিকল্পনায় নেই।
তিনি জানিয়েছেন, দল ভবিষ্যতে সরকারে হোক বা বিরোধী দলে হোক- ভূমিকা নেবে, এবং দলের নেতৃত্ব তার পরিবারের ওপর নির্ভরশীল হবে না। তিনি বলেন, এটা আমার বা আমার পরিবারের ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের জন্য যে ভবিষ্যৎ আমরা সবাই চাই, সেজন্য সাংবিধানিক শাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসতেই হবে। কোনো এক ব্যক্তি বা পরিবার আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে না। তিনি বলেন, অবশ্যই আমি দেশে যেতে চাই, শুধু যদি সরকার বৈধ হয়, সংবিধান রক্ষা পায়, এবং আইন ও শৃঙ্খলা সত্যিকারভাবে বজায় থাকে।
আলাদাভাবে তিনি বৃটেনের দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টকে গণ-আন্দোলনে নিহতদের জন্য ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। ইন্ডিপেন্ডেন্ট তার এই বক্তব্যই তাদের শিরোনাম করেছে। হাসিনা বলেন, গত বছরের রাস্তায় বিক্ষোভ দমনে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রাণঘাতী অভিযানের জন্য তিনি ক্ষমা চাইবেন না।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট লিখেছে, ১৫ বছরেরও বেশি সময় ‘লৌহ মুষ্টিতে’ দেশ শাসন করা শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতের নির্বাসনে রয়েছেন। সাক্ষাৎকারে যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, নিহত বিক্ষোভকারীদের পরিবারের কাছে তিনি ক্ষমা চাইবেন কি-না? জবাবে হাসিনা বলেন, আমি আমাদের প্রতিটি সন্তান, ভাই, বোন ও বন্ধুর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছি, যাদের আমরা জাতি হিসেবে হারিয়েছি। আমি তাদের প্রতি আমার সমবেদনা জানাতে থাকবো। তবে হাসিনা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন যে, তিনি কখনো পুলিশকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেননি। বরং তার দাবি, ‘অনির্বাচিত’ অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে তার দল আওয়ামী লীগকে ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। হাসিনা গত বছরের আন্দোলনের সময় তার পদক্ষেপগুলোর সাফাই দিয়ে বলেন, তিনি কোনো হত্যাকাণ্ডের দায় ব্যক্তিগতভাবে নেন না। বরং তিনি ওই ঘটনাকে বলেন ‘একটি সহিংস বিদ্রোহ’। তার দাবি, বেশির ভাগ হতাহতের কারণ ছিল মাঠ পর্যায়ে নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে ‘শৃঙ্খলাভঙ্গ’ এবং তিনি বলেন, একজন নেতা হিসেবে আমি সার্বিকভাবে দায় স্বীকার করি। কিন্তু এই অভিযোগ যে, আমি গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলাম- এটি সম্পূর্ণ ভুল। তিনি বলেন, তার সরকার প্রথম হত্যাকাণ্ডগুলোর তদন্তে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করেছিল, যা পরে ক্ষমতা গ্রহণের পর অন্তর্বর্তী সরকার বন্ধ করে দেয়।
গত বছরের বাংলাদেশের বিক্ষোভ দমন বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের উপ-আঞ্চলিক পরিচালক বাবুরাম পান্থ তখন বলেন, বিক্ষোভ দমনে নিহতের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তা বাংলাদেশ সরকারের প্রতিবাদ ও মতবিরোধের প্রতি সম্পূর্ণ অসহিষ্ণুতার নির্মম উদাহরণ। জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্ক মন্তব্য করেন, ছাত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও অগ্রহণযোগ্য। তবে হাসিনা ছাত্র আন্দোলনের সময় উল্লিখিত মৃতের সংখ্যা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, ১৪০০ নিহতের সংখ্যাটি সম্ভবত অতিরঞ্জিত। হাসিনা বলেন, সরকারের পদক্ষেপ তখন ছিল- ‘সৎ উদ্দেশ্যে নেয়া ব্যবস্থা, যাতে প্রাণহানি কমানো যায়, কারণ আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল।’
নিজের দেশত্যাগের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যায় হাসিনা বলেন, ‘আমি ৫ই আগস্ট দেশ ছেড়েছিলাম বাধ্য হয়ে। দেশে থাকলে শুধু আমার নয়, আমার আশপাশের মানুষের জীবনও বিপন্ন হতো।’ দেশত্যাগ ও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পরও হাসিনা বলেন, তিনি বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ‘শুধু মুক্ত, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনই দেশকে সুস্থ করবে’।
ওদিকে ড. ইউনূস জানিয়েছেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। তবে আওয়ামী লীগ তাতে অংশ নিতে পারবে না। নিজের উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে হাসিনা বলেন, ‘আমি চাই মানুষ আমাকে সেই নেতা হিসেবে মনে রাখুক, যিনি ১৯৯০-এর দশকে সামরিক শাসনের পর দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছিলেন এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে উত্তরণে সহায়তা করেছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘এই অর্জনগুলো এখন উল্টে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।’