জুলাই-আগস্টে সংঘঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আজ বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) রায়ের দিন ধার্য করবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এ রায়কে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে উত্তপ্ত পরিবেশ। গত কয়েকদিনে সারা দেশে গাড়িতে আগুন দিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। অপরদিকে বিএনপি-জামায়াত ও এনসিপি প্রতিরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। রায়কে কেন্দ্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থান নিয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়েছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা।
এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, শেখ হাসিনার মামলায় রায়ের দিন নির্ধারণের জন্য ১৩ নভেম্বর ধার্য করা হয়েছে। এদিন ট্রাইব্যুনাল ঘোষণা দেবেন কবে রায় দেওয়া হবে। যারা সারা দেশে নাশকতা করছে তাদের বিষয়টি প্রশাসন দেখবে। এ নিয়ে প্রসিকিউটর কোন প্রকার ভীত নয়।
গত ২৩ অক্টোবর বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শুনানি শেষে রায়ের দিন নির্ধারণের জন্য ১৩ নভেম্বর ধার্যের আদেশ দেন। ওই দিন রাষ্ট্রপক্ষে আটর্নি জেনারেল ও চিফ প্রসিকউটরের যুক্তিতর্ক শেষে রায়ের দিন নির্ধারণের তারিখ ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামিম ও মিজানুল ইসলাম। শেখ হাসিনার পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।
এ মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ সাজা চেয়েছে প্রসিকিউশন। আজ (১৩ নভেম্বর) মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনার রায়ের তারিখ পাওয়ার আশা করছেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম। গতকাল বুধবার ট্রাইব্যুনালে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে মিজানুল ইসলাম এ আশার কথা জানান।
মিজানুল ইসলাম বলেন, ট্রাইব্যুনালে হাসিনার বিচার বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তারা বিভিন্নভাবে নানা প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে, কিন্তু বিচার তার নিজস্ব গতিতে চলবে।
মামলার অপর আসামিরা হলেন—সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও এই মামলার রাজসাক্ষী সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এই মামলায় মোট ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন নিজের দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়ে ট্রাইব্যুনালে ইতোমধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার।
গত ১০ জুলাই এ মামলার রাজসাক্ষী হন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। ট্রাইব্যুনালের আদেশে তাকে দোষ স্বীকারের শর্তে ক্ষমা ঘোষণা করা হয়।
গত ১ জুন এই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। শেখ হাসিনার পাশাপাশি আসামি করা হয় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে। প্রসিকিউশন তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনেন। অভিযোগগুলো হলো—
প্রথম : গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের রাজাকারের বাচ্চা ও রাজাকারের নাতিপুতি উল্লেখ করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। গুলি করে প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। আহত হন প্রায় ২৫ হাজার।
দ্বিতীয় : হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে সেই নির্দেশ কার্যকর করেন। গত বছরের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল এবং ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে কথা বলেন শেখ হাসিনা। দুজনের সঙ্গে কথোপকথনের পৃথক অডিও রেকর্ড থেকে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে মারণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। শেখ হাসিনার সেই নির্দেশ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির মাধ্যমে সব বাহিনীর কাছে দেওয়া হয়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তার অন্যান্য অঙ্গসংগঠন এবং ১৪ দলীয় জোটের কাছেও এই নির্দেশ যায়। সেই নির্দেশের আলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এর দায়ে তাদের (হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুন) বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (সর্বোচ্চ দায়) আওতায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
তৃতীয় : রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি আসাদুজ্জামান ও মামুনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
চতুর্থ : রাজধানীর চানখাঁরপুলে আন্দোলনরত নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায়ও শেখ হাসিনার পাশাপাশি ওই দুজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
পঞ্চম : শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুনের বিরুদ্ধে আশুলিয়ায় নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনায়ও অভিযুক্ত করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে মোট চারটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২ জুলাই আদালত অবমাননার একটি মামলায় তাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এটিই প্রথম কোনো মামলা, যেখানে হাসিনার কারাদণ্ড হয়েছে।
গত কয়েক দিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দুর্বৃত্তদের ককটেল বিস্ফোরণ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ নানা জায়গায় পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। এই পরিস্থিতিতে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের আজ লকডাউন কর্মসূচি কেন্দ্র করে নিরাপত্তা জোরদার করেছে প্রশাসন। গত কয়েক দিনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ঢাকায় অবস্থিত রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে, ডিএমপির ৫০টি থানায় অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র অনুযায়ী, পুলিশ পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে থাকার দাবি করলেও কার্যত মাঠপর্যায়ে এর প্রভাব পুরোপুরি লক্ষ্য করা যায়নি। গত কয়েকদিনে দুর্বৃত্তরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যানবাহন থেকে শুরু করে বিভিন্ন যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়েছে। এ ছাড়া মুখোশ ও হেলমেট পরিধানকারী একদল লোক রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নির্বিচারে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ দিনে রাজধানীর ১৫ স্থানে ১৭টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। দুর্বৃত্তরা শুধু ককটেল বিস্ফোরণ বা বাসে আগুন দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না, তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করছে। সর্বশেষ, গত মঙ্গলবার দিনগত রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের গার্লস শাখায় পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। যদিও এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকায় অবস্থিত রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, সুপ্রিম কোর্ট, সচিবালয়সহ প্রধান প্রধান সরকারি অফিসগুলোতে পুলিশের পাশাপাশি পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশ, র্যাব, বিজিবির পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরাও মাঠপর্যায়ে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাজ করছেন।