ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় একাধিক সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে দাবি করেছেন যে বাংলাদেশ পুলিশ ৭.৬২ মিমি রাইফেল ব্যবহার করে না। তিনি আরো দাবি করেছেন, বিরোধী দলীয় নেতারা এই অস্ত্র ব্যবহার করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় প্রতিবাদকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছেন। এর দায় তারা তৎকালীন সরকারের উপর চাপিয়েছে।
তবে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে সুইডেনভিত্তিক অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজ প্রমাণ করেছে যে পুলিশ বিভিন্ন সময়ে সক্রিয়ভাবে এ অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এমনকি গণমাধ্যমটি ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার সময়ও এ ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার প্রমাণ করেছে।
বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) নেত্র নিউজে প্রকাশিত আকিব মো. শাতিলের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, জয়ের দেয়া ভুল তথ্য আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ও এক্স (সাবেক টুইটার) পেজ থেকেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ফেসবুক বা এক্স কর্তৃপক্ষও ভুল তথ্য ছড়ানোর বিষয়ে ফ্যাক্টচেক বা অন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের একটি বক্তব্যের পর ‘আন্দোলনকারীদের কারা হত্যা করেছে’ এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে জয় ওই গুজব ছড়ানো শুরু করেন।
গত ৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগ এক বিবৃতিতে দাবি করে, স্থানীয় রাজনৈতিক বাহিনী এবং বিদেশী সংস্থার সদস্যরা ১৬ জুলাই থেকে ছাত্রদের আন্দোলন ছিনিয়ে নিয়ে হত্যাকাণ্ড শুরু করে। ৭.৬২ মিলিমিটার রাইফেল দিয়ে গুলি করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলে। জয়সহ তাদের দাবি ছিল, বিদেশী এজেন্টরা এ অস্ত্র সরবরাহ করেছে।
জয়ের এ ধরনের দাবির বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। কর্মকর্তারা তাদের ‘শুট অ্যাট সাইট’ (দেখামাত্র গুলি) করার নির্দেশ দেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় প্রকাশ্যেই আন্দোলনকারীদের ‘চরমপন্থী’ বলে তাদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ভারী অস্ত্র ব্যবহারের তথ্য প্রকাশ করেছে। গত ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা তার কর্মীদেরকে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানোর নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে দ্যা বিজনেস স্ট্যাটার্ন্ড খবর প্রকাশ করেছে।
একই দিন একটি টেলিভিশনের খবরে বলা হয়, ঢাকার ধানমন্ডিতে এক আওয়ামী লীগ নেতা একে-৪৭ রাইফেল ব্যবহার করেন। তার ব্যবহৃত গুলি ছিল ৭.৬২ মিলিমিটার। ছোট অস্ত্রের বিষয়ে দক্ষ সাবেক সেনা কর্মকর্তা ড. খান সুবায়েল বিন রফিকের সূত্রে তারা এ খবর দেয়।
ফেনীর একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের কুখ্যাত এক নেতাকে অস্ত্রধারীদের সাথে মিলিটারী গ্রেডের এম-১৫ রাইফেল ব্যবহার করছেন, যা ২-এসটিজি সেমি অটোমেটিক বলে জানিয়েছেন সুবায়েল বিন রফিক।
নেত্র নিউজের কাছে আসা তথ্যে দেখা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বিভিন্ন সময়ে পুলিশকে ৭.৬২ মিলিমিটার রাইফেল ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
নির্বাচন সামনে রেখে ২০২৩ সালের মার্চ মাসে পুলিশ ৩০টি ৭.৬২ মিলিমিটার স্নাইপার রাইফেল সংগ্রহ শুরু করে বলে নিউএজের প্রতিবেদনে বলা হয়। বিরোধীদের আন্দোলন দমন করার জন্য এগুলো সংগ্রহ করা হচ্ছিল। ছাত্র জনতার আন্দোলনের আগে গত মার্চ মাসে আরো ৭.৬২ মিলিমিটার স্নাইপার রাইফেল সংগ্রহের দরপত্র আহ্বান করে পুলিশ। গত ২৪ মার্চ ৫০টি এ ধরএনর অস্ত্র সংগ্রহে উৎপাদক ও সরবরাহকারীদের কাছে দরপত্র চাওয়া হয়।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের দরপত্র দেখা যায়, পুলিশের কাছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ৭.৬২ মিলিমিটার স্নাইপার রাইফেল রয়েছে। ১৮ মেপ্টেম্বরের দরপত্রে ১৫ হাজারটি সেমি অটোমেটিক ৭.৬২ মিলিমিটার রাইফেলের কথা উল্লেখ করা হয়। এ ধরনের টাইপ-৫৬ সেমি অটোমেটিক রাইফেল ব্যবহার করে পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। অস্ত্র বিশেষজ্ঞ ও পুলিশের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, চীনা টাইপ-৫৬ সেমি অটোমেটিক রাইফেলে পুলিশ ও র্যাব ৭.৬২*৩৯ মিলিমিটার বুলেট ব্যবহার করে।
আন্দোলনের সময়ে ছবি ও ভিডিওতেও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ৭.৬২ মিলিমিটার রাইফেল ব্যবহারের তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), আনসার ও বিজিবির টাইপ-৫৬ রাইফেল ব্যবহারের অসংখ্য ছবি প্রকাশ করেছে ডেইলি স্টার। বার্তা সংস্থা এপি’র গত ১৬ জুলাইয়ে প্রকাশ করা ছবিতে বায়তুল মোকাররম এলাকায় পুলিশ সদস্যকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে এ অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যায়। তাদের ৫ আগস্টের আরেকটি ছবিতে এপিবিএনের এক সদস্যকে এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যায়।
গত ২৫ জুলাই এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্রাইসিস এভিডেন্স ল্যাব কয়েকটি ভিডিও বিশ্লেষণ করে এক বিবৃতিতে জানায়, আন্দোলনকারীদের দমাতে টাইপ ৫৬-১ চাইনিজ রাইফেল ব্যবহার করেছে নিরাপত্তা বাহিনী।
আর টিভির প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আন্দোলনকারীদের ওপর ৭.৬২×৩৯ মিলিমিটার গুলি ছুঁড়তে এক পুলিশ সদস্য টাইপ-৫৬ সেমি অটোমেটিক রাইফেল ব্যবহার করছে।
উত্তরা এলাকায় দায়িত্ব পালন করা এক পুলিশ কর্মকর্তা নেত্র নিউজকে বলেছেন, তিনি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে এ ধরনের চাইনিজ রাইফেল ব্যবহার করতে দেখেছেন। তবে তিনি তার পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি। মেজর (অব.) সাফায়েত আহমেদ নেত্র নিউজের একটি ছবি দেখে বলেছেন, পুলিশের ব্যবহৃত রাইফেলটি ‘চাইনিজ রাইফেল’ হিসেবে পরিচিত ৭.৬২ মিলিমিটারের টাইপ-৫৬।
তিনি বলেন, বায়তুল মোকাররম এলাকায় ব্যবহার হয়েছে ৭.৬২ মিলিমিটারের সাব-মেশিন গান (এসএমজি) টাইপ-৫৬, যা অটোমেটিক। এটির ট্রিগার চেপে রাখলে ম্যাগজিন খালি হয়ে যাবে। এগুলোতে টাইপ-৫৬ বলা হয়, কারণ ওই বছর থেকে ইএসএসআর থেকে প্রযুক্তি ও লাইসেন্স নিয়ে চীন উৎপাদন শুরু করে।
নেত্র নিউজের খবরে বলা হয়েছে, আন্দোলনের সময় পুলিশের ৭.৬২ মিলিমিটার রাইফেল ব্যবহারের বিষয়ে এসব প্রমাণ সজিব ওয়াজেদ জয়ের দাবির সাথে সাংঘর্ষিক। সরকারি নথি, বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং অন্যান্য তথ্য-উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী আন্দোলকারীদের বিরুদ্ধে ৭.৬২ মিলিমিটার রাইফেল ব্যবহার করেছে।