চট্টগ্রাম নগরের হাজারি গলিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার ঘটনায় ইসকন সমর্থকদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার কথা বলছে পুলিশ। তবে পুলিশের এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রবর্তক ইসকন শ্রী কৃষ্ণ মন্দিরের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস ব্রহ্মচারী বলছেন, ‘ইসকন সদস্যদের জড়িত থাকার প্রশ্নই আসে না।’
এদিকে এ ঘটনায় ৫৮২ জনকে আসামি করে থানায় মামলা হয়েছে। মামলায় আটক ৮২ জনের মধ্যে ৪৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ওই ঘটনায় রাজনৈতিক মদদ রয়েছে কি না তাও পুলিশ তদন্ত করে দেখছে।
বুধবার (৬ নভেম্বর) বিকেল সাড়ে ৩টায় নগরের দামপাড়া পুলিশ লাইন্সের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (অপরাধ) রইছ উদ্দিন।
হামলায় পুলিশের ৯ জন আহত হওয়ার তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘ইসকনকে নিয়ে দেওয়া একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে ওসমান আলী নামে এক ব্যক্তিকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে— এমন তথ্য ৯৯৯-এ পেয়ে আমাদের কোতোয়ালী থানা পুলিশ রেসপন্স করে। তারা সেখানে গেলে অবরুদ্ধ ওসমান নামে ওই ব্যক্তিকে উশৃঙ্খল জনতা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। পরিস্থিতির অবনতি হলে সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ এবং সেনাসদস্যসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত হন। ছিনিয়ে নেওয়ায় বাধা দেওয়ায় উশৃঙ্খল জনতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ইটপাটকেল ও এসিড নিক্ষেপ করলে আমাদের ৯ জন সদস্য আহত হন। যার মধ্যে একজন এসিড দগ্ধ হয়েছেন।’
হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে আটকের সংখ্যা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে বিপুল সংখ্যক ব্যক্তিকে আটক করা হলেও যাচাই বাছাই করে আমরা ৮২ জনকে আটক করেছি। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ইসকন সমর্থক। কয়েকজন মুসলিম থাকতে পারে। এটিও যাচাই-বাছাই চলছে।’
হাজারি গলির ওষুধের কয়েকটি দোকান সিলগালা করায় নগরজুড়ে রোগীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন—এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রইছ উদ্দিন বলেন, ‘বন্ধ করার জন্য নির্দেশনা আমাদের নেই। নিরাপত্তার স্বার্থে যেন সেখানে কোনো নাশকতা বা লুটতরাজ না হয় এজন্য কয়েকটি দোকান জেলা প্রশাসন সিলগালা করে সাময়িক বন্ধ করেছে। কিন্তু সব দোকান বন্ধ করা হয়নি।’
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে তিনি জানান, ঘটনার সাথে যারা জড়িত ছিল তারা ‘জয় শ্রীরাম’ বলে স্লোগান দিয়েছে। ‘আর ফেসবুকে যে মিথ্যা প্রচার-প্রচারণা করা হয়েছে— সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করে জানতে পেরেছি, ইসকন সমর্থকরাই জড়িত রয়েছে।’ বলেন সিএমপির এই কর্মকর্তা।
ঘটনার সাথে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আটকদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। কোনো রাজনৈতিক মদদ রয়েছে কিনা সেটিও তদন্ত করা হচ্ছে। শান্ত নগরীকে যারা বিশৃঙ্খল করতে চায়, তাদের বিষয়ে আমাদের কার্যক্রম চলমান। অস্থিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে যেন নাশকতা বা লুটতরাজ করতে না পারে সেই কার্যক্রম আমাদের আগেও ছিল এখনো রয়েছে।’
এ ঘটনার জেরে আগামীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শঙ্কা রয়েছে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে ডিসি রইছ উদ্দিন বলেন, ‘কোনো ছোট-খাটো ইস্যুকে কেন্দ্র করে যাতে এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যাপারে আমরা তৎপর রয়েছি। আমাদের জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার কারণে যাকে অবরুদ্ধ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তার বিরুদ্ধ ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা—প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ওসমান আলী বর্তমানে কাস্টডিতে আছে। যদি এখানে কেউ ধর্মীয়ভাবে সংক্ষুব্ধ হয়েছে— এমন অভিযোগ ওসমান আলীর বিরুদ্ধে নিয়ে আসে তাহলে তার বিরুদ্ধে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’
সনাতনীদের অন্যান্য সংগঠনের নেতাদের সাথে সমাধানের জন্য বৈঠক করা হবে কিনা—জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্তা বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, এই নগরকে শান্তি-শৃঙ্খলার নগর হিসেবে চাই। এই শৃঙ্খলা যারা নষ্ট করবে তারা শুভবুদ্ধির পরিচয় দেয় না। যারা শুভবুদ্ধির পরিচয় দিবে তাদেরকে নিয়ে অবশ্যই আমরা আমাদের লক্ষ্যযাত্রায় এগিয়ে যেতে চাই।’
হামলার ঘটনায় ইসকন জড়িত নয় : স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস
হামলায় জড়িত থাকা নিয়ে পুলিশের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রবর্তক ইসকন শ্রী কৃষ্ণ মন্দিরের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস ব্রহ্মচারী বলছেন, ইসকন সদস্যদের জড়িত থাকার প্রশ্নই আসে না।’
সিভয়েস২৪’কে তিনি বলেন, ‘আমরা যতটুকি শুনেছি, ফেসবুকে একজন ইসকনের বিরুদ্ধে পোস্ট করেছে। এরপর হাজারি গলির স্থানীয় হিন্দুরা ওর দোকানে গিয়ে হামলা করতে চেয়েছে। এখানে আমাদের ইসকন সদস্যদের জড়িত থাকার প্রশ্নই আসে না।’
তিনি বলেন, ‘দোকান ভাঙা তো আমাদের কাজ নয়।’
পুলিশের মামলায় আসামি ৫৮২
এদিকে, গতকাল রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার ঘটনায় নগরের কোতোয়ালী থানায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে। মামলায় ঘটনাস্থল থেকে আটক ৮২ জনের মধ্য ৪৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আজ দুপুরে কোতোয়ালী থানার উপপরিদর্শক মিজানুর রহমান বাদী হয়ে পুলিশের কাজে বাধাদান এবং হামলার অভিযোগ এনে এসিড দমন আইনে মামলাটি দায়ের করেন।
মামলার বিষয়টি সিভয়েস২৪’কে নিশ্চিত করেছেন নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) কাজী মো. তারেক আজিজ।
তিনি জানান, গতকাল হাজারি গলিতে উশৃঙ্খল জনতাকে নিবৃত্ত করতে যাওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর এসিড ও ইটপাটকেল দিয়ে হামলার ঘটনায় কোতোয়ালী থানার একজন উপপরিদর্শক বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় আটক ৮২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
যা ঘটেছিল হাজারি গলিতে
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কিছুদিন আগে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী তার প্রোফাইলে একটি ফটোকার্ড শেয়ার করেন। সেখানে ইসকন নিয়ে ‘কুরুচিপূর্ণ’ মন্তব্য ছিল। ফটোকার্ড সম্বলিত সেই পোস্ট মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে শেয়ার করেন হাজারী গলির মিয়া শপিং সেন্টারের মোল্লা স্টোর নামে দোকান মালিক ওসমান গণি। আর সেই পোস্টে ক্ষুব্ধ হয়ে একইদিন বিকেল ৪টার দিকে স্থানীয়দের একাংশ সেই দোকান ভাঙচুর করে এবং ওই ব্যবসায়ীর ওপর আক্রমণ চালায়।
একপর্যায়ে তাকে অবরুদ্ধ করার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এ সময় বিক্ষুব্ধরা পোস্টদাতা ওই ব্যক্তিকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি করেন। কিন্তু পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হেফাজতে নিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চড়াও হয় বিক্ষুব্ধরা। এরপর তারা পুলিশ ও সেনাসদস্যদের ওপর ‘এসিড’ ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে হামলাকারী দুর্বৃত্তরা সংঘর্ষে জড়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে। এরপরই জড়িতদের গ্রেপ্তারে রাত আনুমানিক ১১টা পর্যন্ত অভিযান চালায় যৌথবাহিনীর সদস্যরা।
হামলায় আহত পুলিশ সদস্যরা হলেন—নগর পুলিশের কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার মো. মাহফুজুর রহমান, কনস্টেবল সাইফুল ইসলাম, মো. বিপ্লব ব্যাপারী, আবু সায়েম সেজান, মো. সাইদ হাসান, ফয়েজ, নাহিম আশিকুর এবং শাহাজাহান হোসেন শাওন। এদের মধ্যে ফয়েজ এসিডদগ্ধ হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
সিভয়েস২৪/রবি