বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার জোর গলায় দাবি করেছে, হিন্দু নির্যাতনের অভিযোগ ভারতীয় মিডিয়ার অতিরঞ্জিত প্রচার। ইউনূস সরকার ভারতসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশে গিয়ে অভিযোগের সরজমিনে তদন্ত করতে।
অন্যদিকে ভারতে শুধু সংবাদমাধ্যম নয়, নরেন্দ্র মোদির সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একাধিকবার প্রতিবেশী দেশে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় সরব হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে প্রথম ফোনালাপেই এই ব্যাপারে তার উদ্বেগের কথা জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
সেই বাংলাদেশেরই এক উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতা হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলছেন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক।
শনিবার সকালে ঢাকা থেকে ফোনে দ্য ওয়াল’কে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘৫ অগাস্টের পর হিন্দুদের ওপর হামলার যে অভিযোগ ভারত সরকার ও ভারতীয় মিডিয়া করেছে তা সবই মিথ্যা। সবটাই আওয়ামী লিগের অপ্রচার।’ তার কথায়, ‘বাংলাদেশের জন্মের পর এই প্রথম রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও সংখ্যালঘুরা নিরাপদ ছিলেন এবং আছেন। আর তা নিশ্চিত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মী-সমর্থকেরা।’
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী দীর্ঘদিন সে দেশে হিন্দুর ঐক্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন। ৯০ ভাগ মুসলিমের দেশে তার সংগঠন প্রায় চারশো বৈদিক স্কুল পরিচালনা করে। প্রতি শুক্র ও শনিবার সরকারি সাপ্তাহিক ছুটির দিনে স্কুলগুলোতে কয়েক হাজার হিন্দু ছেলেমেয়েকে ধর্মের পাঠ দেওয়া হয়। এছাড়া সংগঠন পূজা পাঠের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
২৩টি হিন্দু সংগঠনের এই মহাজোটের মূল রাজনৈতিক দাবি, বাংলাদেশ সংসদে সংখ্যালঘুদের জন্য আসন সংরক্ষণ এবং পৃথক ভোটার তালিকা। গোবিন্দ প্রামাণিকের কথায়, দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে বহু বছর পৃথক ভোটার তালিকা ছিল। ফলে সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুরা সংসদে, প্রাদেশিক সভায় তাদের প্রতিনিধি পাঠাতে পারত। যৌথ ভোটার তালিকা হওয়ার পর হিন্দুরা হয়ে গিয়েছে দাবার ঘুঁটি। মুসলমানদের সংসদে পাঠানোই তাদের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংসদের দরজা তাদের জন্য এক প্রকার বন্ধ।
হিন্দু ঐক্য প্রতিষ্ঠার কাজের সূত্রেই আরএসএস, বিশ্বহিন্দু পরিষদ ও বিজেপি শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের এই নেতার বহুদিনের যোগাযোগ। মোহন ভাগবত তাকে চেনেন, জানেন। নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে গেলে তার সঙ্গে দেখা করে সে দেশে হিন্দুদের সমস্যার কথা তুলে ধরে ভারত সরকারকে উপযুক্ত পদক্ষেপ করার আর্জি জানান গোবিন্দ প্রামাণিক। বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে আরএসএসের সুরে ‘অখণ্ড ভারত’ গড়ার ডাক দেয়ায় বারে বারে বাংলাদেশের গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর কুনজরে পড়েছেন তিনি। আবার এই জাতীয় কথাবার্তা এবং কর্মকাণ্ডের জন্যই অনেকে তাকে ‘বাংলাদেশের মোহন ভাগবত’ বলে থাকেন। তাঁর কথায়, ‘বাংলাদেশে জমানা নির্বিশেষে হিন্দুরা নিপীড়নের শিকার। এইভাবে চললে আর বছর কয়েকের মধ্যে বাংলাদেশ হিন্দু শূন্য হয়ে যাবে।’
সেই তিনিই আবার বলছেন, ‘৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর হিন্দুসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারাও গা ঢাকা দেন। মন্দির, গির্জা সব অরক্ষিত হয়ে পড়েছিল। সেই পরিস্থিতিতে বিএনপি ও জামায়াতের কর্মী-সমর্থকেরা এবং মাদ্রাসার ছাত্ররা অন্তত দিন পনেরো মন্দির পাহারা দিয়েছেন। সংখ্যালঘুদের ঘর-বাড়ি তারাই রক্ষা করেছেন। বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতারা এজন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রামাণিকের কথায়, ‘বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষার এমন নজির অতীতে একটিও নেই।’
অন্তর্বর্তী সরকারকেও সমান কৃতিত্ব দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূস অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি এবং তিনি ও তার উপদেষ্টারা সকলেই অসাম্প্রদায়িক। তাই সংখ্যালঘুর জানমাল রক্ষা পেয়েছে।’
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বড় সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সংখ্যালঘুদের স্বার্থে কাজ করে থাকে। ৫ অগাস্ট পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে সেই সংগঠনের বক্তব্য অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।
গত মাসে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ঐক্য পরিষদ দাবি করে, ৪ অগাস্ট রাত থেকে ২০ অগাস্টের মধ্যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর উপর হামলার ২০১০টি ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে বেশিরভাগই হিন্দুদের বাড়িঘর এবং দোকান-অফিস। নিহত হয়েছেন নয়জন। ঐক্য পরিষদ সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করার পাশাপাশি রাষ্ট্রসংঘের তত্ত্বাবধানে হামলার ঘটনার তদন্তের দাবি তুলেছে। তারা বলেছে, অতীতেও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাগুলির তদন্ত হয়নি। সাজা পায়নি অপরাধীরা।
অন্যদিকে, ঐক্য পরিষদের এই রিপোর্ট সম্পূর্ণ বানানো, অতিরঞ্জিত আখ্যা দিয়ে হিন্দু মহাজোটের নেতা গোবিন্দ প্রামাণিক বলছেন, ‘হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের পনেরো বছরের কুশাসনের ফলে মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভের আগুন তৈরি হয়েছিল তার তেমন প্রতিফলন ৫ অগাস্টের পর হয়নি। আমরা আশঙ্কা করেছিলাম, আরও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবে। কিন্তু হয়নি। হলে একটা মন্দিরও হয়তো আস্ত থাকত না।’ তাঁর কথায়, ‘সংখ্যালঘুদের উপর হামলার বিক্ষিপ্ত যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলো একটিও সাম্প্রদায়িক কারণে হয়নি। হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। আক্রান্ত হিন্দু নেতারা আওয়ামী লীগের দালালি করতেন। ক্ষিপ্ত মানুষ হাসিনার সমর্থকদের ওপর হামলা করে। তাতে হিন্দু-মুসলিম দুই-ই ছিল। হিন্দু বলে কাউকে আক্রমণ করা হয়নি।’
এই ব্যাপারে ভারত সরকারকেও কাঠগড়ায় তুলেছেন বাংলাদেশের এই কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা। তার কথায়, ‘বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ যাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল সেই শেখ হাসিনাকে ভারত সরকার বছরের পর বছর সমর্থন দিয়ে গিয়েছে।’ গোবিন্দ প্রামাণিকের কথায়, ‘২০১৪ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত হাসিনা জমানায় অনুষ্ঠিত ভোটগুলোতে আওয়ামী লীগের মুসলিম সমর্থকেরাও সকলে ভোট দেয়নি। কিন্তু ভারত সরকার আর তাদের এজেন্সির চাপাচাপিতে হিন্দুরা সদলবলে গিয়ে ভোট দিতে বাধ্য হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে আওয়ামী লিগ ও হিন্দু সমাজ একাকার হয়ে গিয়েছে। ভারত সরকারের কথায়, চলতে গিয়ে হিন্দুরা এ দেশে আরও একঘরে হয়ে যাচ্ছে।’
গোবিন্দ প্রামাণিকের কথায়, ‘নরেন্দ্র মোদি হিন্দুর স্বার্থ রক্ষার কথা বলেন। অথচ হাসিনার সময়ে বাংলাদেশে হিন্দুরা যে নিপীড়ন, অত্যাচারের শিকার হয়েছে তা নিয়ে নরেন্দ্র মোদি, ভারত সরকার টুঁ শব্দটি করেনি।’
এই হিন্দু নেতার কথায়, হালের হিংসায় একজন হিন্দু মারা গিয়েছেন। তবে সেটা সাম্প্রদায়িক হামলার কারণে নয়, জমি নিয়ে হিন্দু প্রতিবেশীর সঙ্গে বিবাদের কারণে খুন হন তিনি।’ তার কথায়, ‘আমি নিজে দশটি হামলার ঘটনার তদন্ত করে দেখেছি, হিন্দুরা নিজেদের গোলমালকে সাম্প্রদায়িক বলে অভিযোগ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদি যদি সত্যিই বাংলাদেশের হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষা করতে চান তাহলে ইউনূসকে বলুন সংখ্যালঘুদের জন্য সংসদে আসন সংরক্ষণ আর পৃথক ভোটার তালিকার ব্যবস্থা করতে।’
হিন্দু মহাজোটের মহাসচিবের কথায়, ‘নরেন্দ্র মোদি, আরএসএস, বিশ্বহিন্দু পরিষদের কাছে বাংলাদেশের হিন্দুদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু আমরা হতাশ। বাংলাদেশের হিন্দুদের নিয়ে বিজেপি সরকার ভাবে না। তারা বাংলাদেশ বলতে বোঝে শেখ হাসিনা, যার আমলে হিন্দুদের ওপর সীমাহীন নির্যাতন হয়েছে। ২০২১-এ পূজার সময় সাম্প্রদায়িক হিংসায় ১১জন হিন্দু খুন হন। একটি খুনেরও বিচার হয়নি।’
সূত্র: দ্য ওয়াল