সংসদ সদস্য হওয়ার আগে তেমন কিছু ছিল না তাঁর। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থাকতেন শ্বশুরবাড়িতে। সাধারণ জীবনযাপন করতেন। ২০১৮ সালে ‘রাতের ভোটে’ জয়ী হওয়ার পর সব কিছুই বদলাতে শুরু করে। পাঁচ বছরে রাজধানী ও নিজ এলাকায় পাঁচটি বাড়ি, দুটি দামি গাড়ি, প্রায় ৭০ বিঘা ফসলি জমিসহ অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি।
তিনি হলেন খুলনা-৬ (কয়রা ও পাইকগাছা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু। স্থায়ী বাসিন্দা না হয়েও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে নির্বাচিত হওয়ার পর গড়ে তুলেছেন শতকোটি টাকার সম্পদ। সংসদীয় এলাকার অধিকাংশ সড়ক, ভবন, বেড়িবাঁধ মেরামতকাজ করতেন নিজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জামান এন্টারপ্রাইজের নামে। একাধিক ব্যক্তির জমি দখল করে নিয়েছেন– এমন অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। বিরোধী দলের পাশাপাশি নিজ দলের নেতাকর্মীকেও দমনপীড়নে ছাড় দেননি। একাধিকবার এলাকার নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের হাতে নিগৃহীতও হয়েছেন। এসব কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাননি। গত ৫ আগস্ট থেকে পরিবার নিয়ে পালিয়ে রয়েছেন।
২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় তিনি পেশা উল্লেখ করেছিলেন ঠিকাদারি ব্যবসা। হলফনামায় তাঁর ১ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে বলে উল্লেখ আছে। এমপি হওয়ার পর পাঁচ বছরে এলজিইডি, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন দপ্তরে নামে-বেনামে কাজ বাগিয়েছেন। এসব কাজের জন্য নিজের ঠিকাদারি লাইসেন্স ছাড়াও অন্যের নামে থাকা কমপক্ষে ১৫টি লাইসেন্স ব্যবহার করেছেন।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৫ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করেছে তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠান জামান এন্টারপ্রাইজ। এসব কাজের ৯৫ শতাংশ করেছেন তিনি সংসদীয় এলাকায়। ওই সময়ে দলীয় কর্মীদের ঠিকাদারি লাইসেন্সে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অন্তত ৩৫টি স্থানে বাঁধ মেরামত কাজ করেছেন। এ ছাড়া সংসদীয় এলাকার সব ঠিকাদারি কাজে চুক্তি মূল্যের ১০ শতাংশ টাকা তাঁকে অগ্রিম দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। এভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন শতকোটি টাকা।
যুবলীগ নেতা ও খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল আহসান টিটুর ঠিকাদারি লাইসেন্সে কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চার তলা ভবন নির্মাণকাজও করছিলেন তিনি। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৯ কোটি টাকা। কাজটির মেয়াদ শেষ হলে একাধিকবার সময় বাড়িয়ে নির্মাণকাজের ১০ শতাংশও করতে পারেননি এখন পর্যন্ত। কিন্তু যে পরিমাণ কাজ করেছেন, সে তুলনায় বিল বেশি তুলে নিয়েছেন। তিনি উত্তোলন করেছেন ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রেজাউল করিম বলেন, ‘এমপির কাজ হওয়ায় সে সময় কিছু বলতেও পারিনি। কাজের তাগাদা দিলে উল্টো হুমকি দিতেন। ভবন নির্মাণ না হওয়ায় সীমহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে রোগীসহ হাসপাতালে কর্মরত সবাইকে।’
সংসদীয় এলাকায় ঠিকাদারি কাজে যুক্ত থেকে তিনি সরকারি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১২ ধারার (ট) উপধারা লঙ্ঘন করেছেন বলে অভিযোগ সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) কয়রা উপজেলা শাখার সভাপতি মোস্তফা শফিকুল ইসলামের। তিনি বলেন, সংসদ সদস্য হয়ে ঠিকাদারি কাজ করা জনগণের সঙ্গে এক ধরনের ধোঁকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এমপি হওয়ার পর খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) ময়ূরী আবাসিক এলাকায় প্লট কিনেছেন ৬০ লাখ টাকায়। নিজের নামে নগরীর টুটপাড়া এলাকার ফরিদ মোল্লার মোড়ে ৩ কাঠা প্লটে গড়ে তুলেছেন ৫ তলা বাড়ি। ঢাকার মোহাম্মদপুরে শেলটেকের ফ্ল্যাট ছাড়াও ঢাকার গাজীপুরে কিনেছেন প্রায় ১০ বিঘা জমি। বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলায় পৈতৃক এলাকায় কৃষিজমি কিনেছেন ৩০ বিঘা। তাঁর নানার বাড়ি পাইকগাছার গড়ইখালী এলাকায় ২৫ বিঘা ফসলি জমি কিনেছেন। এ ছাড়া কয়রা এবং পাইকগাছা উপজেলায় দুটি বাড়ি তৈরি করেছেন। এর মধ্যে কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ কলেজের সামনে শাহাবুদ্দিন সরদারের জমি জোরপূর্বক দখলে নিয়েছিলেন। এ নিয়ে ভুক্তভোগীর পরিবার আদালতে মামলাও করে। পরে বাবু ও তাঁর লোকজনের চাপে মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।
এ বিষয়ে শহাবুদ্দিনের ছেলে গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ওয়ায়েজ কুরুনি বলেন, ‘আমি ফেসবুক লাইভে জমি দখলের বিষয়টি বলেছিলাম। এমপি সে সময় অন্য একজনকে মালিক সাজিয়ে জমি দখলে নিয়ে বাড়ি বানান। পরে এমপি এলাকা থেকে আমাদের উচ্ছেদের হুমকি দেন। সেই সময় আমরা ভয়ে মুখ খুলতে পারিনি।’
নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য লাঞ্ছিতও হয়েছেন আক্তারুজ্জামান বাবু। ২০২১ সালের ১ জুন কয়রা উপজেলার দশহালিয়া এলাকায় পাউবোর বাঁধ মেরামত কাজ পরিদর্শনে গেলে উত্তেজিত এলাকাবাসী তাঁকে কাদা ছুড়ে মারেন। এলাকার শত শত মানুষ মারতে উদ্যত হলে পালিয়ে বাঁচেন তিনি। এরপর থেকে এলাকায় তাঁর নাম হয়ে যায় ‘কাদা খাওয়া এমপি’। এ ছাড়া ২০২৩ সালের ২৪ আগস্ট কয়রা উপজেলার কালনা আমিনিয়া ফাজিল মাদ্রাসা মাঠে একটি সভায় উপস্থিত হলে সেখান থেকেও তাঁকে অপদস্থ করে তাড়িয়ে দেন দলীয় নেতাকর্মীরা।
আক্তারুজ্জামান বাবুর বিরুদ্ধে ক্ষোভের যেন সীমা নেই পাইকগাছা উপজেলাবাসীরও। পাইকগাছা উপজেলায় একটি বাস টার্মিনাল হবে– এমন দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করে আসছিল এলাকার মানুষ। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পৌর এলাকার শিববাটি মৌজায় ১ দশমিক ৫ একর জমি বরাদ্দ দেন। জায়গাটি বাবুর বাড়ির কাছে হওয়ায় সেখানে তিনি বাস টার্মিনাল হতে দেননি।
পাইকগাছা উপজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি শেখ হারুনুর রশীদ হিরু বলেন, ‘এতদিন পাইকগাছায় টার্মিনাল হয়ে যেত। শুধু বাবুর কারণে হয়নি। অথচ এখানে তাঁর কোনো জমি ছিল না।’
পাইকগাছা নাগরিক কমিটির সভাপতি মোস্তফা কামাল জাহাঙ্গীর বলেন, এমপি পদ ব্যবহার করে একজন সাধারণ দলীয় কর্মী থেকে শত শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন আক্তারুজ্জামান বাবু। সংসদীয় এলাকায় ‘বাবুলীগ’ নামে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তাঁর বাহিনীতে সাবেক বনদস্যু থেকে শুরু করে এলাকার চিহ্নিত দুর্বৃত্তরা ছিল।
এদিকে বাবুর এসব দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৯ অক্টোবর বাবু ও তাঁর স্ত্রী শারমিন আক্তারের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন আদালত। তবে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে।