নতুন পোশাকে দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন পুলিশ সদস্যরা। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের অভিযোগ ও সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বাহিনীর পোশাকের রঙ পরিবর্তনের দাবি ওঠে।
নতুন পোশাকে দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন পুলিশ সদস্যরা। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের অভিযোগ ও সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বাহিনীর পোশাকের রঙ পরিবর্তনের দাবি ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকার চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাব ও আনসার বাহিনীর পোশাক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের অনুমোদন করা লৌহ বর্ণের নতুন পোশাকই পুলিশ সদস্যরা পরতে শুরু করেছেন। গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে এ পোশাকে কার্যক্রম শুরু হলেও আজ থেকে মাঠ পর্যায়ে তা দৃশ্যমান হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
গতকাল সরজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে লৌহ রঙের নতুন পোশাকে পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। বিকালের দিকে গুলশান ১ ও ২ নম্বরের মাঝামাঝি, ফার্মগেট এবং কারওয়ান বাজার এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের দেখা যায় নতুন পোশাকে। পাশাপাশি রাজারবাগ পুলিশ লাইনসসহ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদেরও নতুন পোশাকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। তবে সব থানায় এখনো নতুন পোশাক সরবরাহ শেষ না হওয়ায় অনেকেই আগের পোশাকে দায়িত্ব পালন করছেন।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. ইবনে মিজান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পুলিশের নতুন রঙের পোশাক সরবরাহ শুরু হয়েছে। আজ (শনিবার) ট্রাফিক বিভাগের সদস্যরা নতুন পোশাকে দায়িত্ব পালন করেছেন। থানার ফোর্স কাল (রোববার) থেকে পুরোদমে নতুন পোশাকে দায়িত্ব পালন শুরু করবেন।’
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুলিশের পোশাক হয়েছে লৌহ (আয়রন) বর্ণের। জানা গেছে প্রথমে মেট্রোপলিটন এলাকা, পরবর্তী সময়ে পুলিশের সব ইউনিট নতুন পোশাক পাবে। প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে তিন সেট করে পোশাক দেয়া হচ্ছে। পোশাকের সঙ্গে থাকছে এক সেট বুট, বেল্ট ও ক্যাপ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রত্যেক সদস্যের নতুন পোশাক বাবদ খরচ পুলিশের বাজেট থেকে ব্যয় করা হচ্ছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শাসনামলে পুলিশকে অনুগত বাহিনী হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ের সরকারগুলো তাদের পছন্দ অনুযায়ী পদোন্নতি ও পোস্টিং দিয়ে মেধাবীদের বঞ্চিত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে খোদ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যেই। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেক পুলিশ কর্মকর্তার বেপরোয়া আচরণ সমালোচিত হয়েছে। জুলাই আন্দোলন শুরু হওয়ার পর অতি উৎসাহী এ কর্মকর্তারা নির্বিচারে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশনা দিয়েছেন। এমনকি আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এসব উচ্চাভিলাষী পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। অনেকে গ্রেফতার হয়ে বিচারের মুখোমুখি। বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে এমন নজির আর নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগে ফৌজদারি অপরাধে অনেক পুলিশ কর্মকর্তার বিচার হলেও মানবতাবিরোধী অপরাধে সাবেক আইজিপিসহ এত সংখ্যক পুলিশ সদস্য গ্রেফতার ও পালিয়ে যাওয়ার রেকর্ড নেই।
উল্লেখ্য, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগে সমালোচিত পুলিশ বাহিনীর সংস্কার ও পোশাক পরিবর্তনের দাবি ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকার জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর। এ কমিশন সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন পোশাক বদলের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের জন্য স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ, মৌলিক সুবিধাদি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পোশাকের আগে পুলিশের দরকার উন্নত প্রশিক্ষণ এবং ভালো কাজের পরিবেশ। আমরা তাদের মানসম্মত বেতন দিতে পারছি না, স্বাস্থ্যকর আবাসন ব্যবস্থা দিতে পারছি না, তাদের দিয়ে অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা ডিউটি করাচ্ছি। এগুলো অব্যাহত রেখে শুধু পোশাক পরিবর্তনে পুলিশের সেবার মান বাড়বে না। পুলিশ সদস্যদের জন্য স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে তাদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যাবে।’
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ পুলিশের পোশাকে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ২০০৪ সালে। সেই বছর পুলিশের খাকি পোশাক পরিবর্তন করে মহানগরে হালকা জলপাই রঙের করা হয়। জেলা পুলিশকে দেয়া হয় গাঢ় নীল রঙের পোশাক। এবার পুলিশকে দেয়া হলো লৌহ রঙের পোশাক। গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুলিশের নতুন পোশাক নিয়ে নেটিজেনদের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকেই মন্তব্য করেছেন যে নতুন পোশাকটি দূর থেকে বা অনেক মানুষের মধ্যে যথেষ্ট দৃশ্যমান মনে হবে না।
পোশাক পরিবর্তনের পাশাপাশি পুলিশকে পেশাদারত্ব বজায় রেখে কাজের সুযোগ করে দেয়া জরুরি বলে মনে করেন বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্বাধীনতা উত্তরকালে পুলিশের ছিল খাকি পোশাক। পরে পরিবর্তন এনে নানা রঙের পোশাক দেয়া হয়েছে। পোশাকের এ পরিবর্তন কিন্তু স্থায়ী না। আসল পরিবর্তনটা হচ্ছে মননে, মেজাজে। পুলিশকে পেশাদারত্ব ঠিক রেখে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।’
নতুন রঙের পোশাকের চেয়ে পুলিশের সংস্কার আগে প্রয়োজন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘নতুন পোশাকের চেয়ে পুলিশের বেশি প্রয়োজন ছিল তাদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলোর সংস্কার। তাদের কর্মকাণ্ডে নতুনত্ব আনা। একই সঙ্গে পুলিশের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ প্রয়োজন।’
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে শনিবার থেকে পুলিশ নতুন পোশাকে দায়িত্ব পালন শুরু করেছে। কাল (রোববার) থেকে নতুন রঙের পোশাকে পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাবে। প্রথমে ডিএমপিসহ সব মেট্রোপলিটনে নতুন পোশাক সরবরাহ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবগুলো ইউনিট নতুন পোশাক পাবে।’