তানজিনা আক্তার ইভা ওরফে মেরি ওরফে মাহি। ফেসবুক, ইনস্ট্রাগ্রাম, টিকটক, স্ন্যাপচ্যাটসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট আছে তার। ওইসব অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে টার্গেট ব্যক্তিদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে এবং ম্যাসেঞ্জারে নক করেন তিনি। এক পর্যায়ে টার্গেটের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর নেন এবং নিজেকে কুমারী বলে পরিচয় দেন। এরপর শুরু করেন প্রতারণা। এভাবে তার ফাঁদে শতাধিক পুরুষ পা দিয়েছেন। অবশেষে গোয়েন্দা পুলিশের জালে ধরা পড়েন ওই প্রতারক ইভা। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, ইভা টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে গুলশানের বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে লাঞ্চ বা ডিনারের অফার করেন। দেখা-সাক্ষাতের এক পর্যায়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যে প্লাটফর্মই ব্যবহার করুক না কেন টার্গেট ব্যক্তিকে দিয়ে অধিকতর নিরাপত্তার কথা বলে স্ন্যাপচ্যাটে অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে নেন। অথবা যে টার্গেটের ম্যাপচ্যাটে অ্যাকাউন্ট রয়েছে তাকে সেখানে আসতে বলে সেখানে অর্ধনগ্ন বা নগ্ন ছবি পাঠাতেন। এছাড়া টার্গেটকৃতকে রসাত্মক কথাবার্তা চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেন। হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন মাধ্যমে টার্গেটের সাথে অডিও, ভিডিও এবং ম্যাসেজের কথোপকথনের রেকর্ড সংরক্ষণ করেন।
শুধু তাই নয়, ইভা টার্গেট ব্যক্তির সঙ্গে বিভিন্ন হোটেলে রাত যাপন করে মোটা অংকের টাকা সুকৌশলে হাতিয়ে নেন। টার্গেট ব্যক্তিকে তিনি বিভিন্ন নাইট পার্টি, স্পা সেন্টার এবং বারে নিয়ে যান এবং বিভিন্ন অনৈতিক কাজে আকৃষ্ট করে নিজের স্বার্থ হাসিল করেন।
ইভা নিজেকে কুমারী পরিচয় দিয়ে তার মোহনীয় মায়ায় আকৃষ্ট করে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, নেতা, উচ্চপদস্থ চাকরিজীবী এমন ১০ জনকে সাময়িক সময়ের জন্য বিয়ে করেন। পরে তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন। এছাড়া তার ব্ল্যাকমেইলের শিকার এমন শতাধিক ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে, যাদের সাথে তিনি ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে নিজেকে মোহনীয় রূপে উপস্থাপন করে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০০৩ সালে এক প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি চাকরিজীবীর সঙ্গে ইভার পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। ইভার উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য তার প্রথম স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয় ২০১০ সালে। ইতোমধ্যে তিনি লাগামহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রথম স্বামীর সাথে তার তিনটি সন্তান থাকলেও ইভা তাদের নিজের সন্ধান বলে পরিচয় দেন না। প্রথম স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্সের আগেই তিনি একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদের প্রতারিত করেন। এভাবেই তিনি একে একে ১০টি বিয়ে করেন এবং প্রতারণার মাধ্যমে শতাধিক ব্যক্তির সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে রাত যাপনের তথ্য পাওয়া যায়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ২০২২ সালের প্রথম দিকে রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলের বারে রাজুর সঙ্গে পরিচয় হয় তানজিনা আক্তার ইভার। বিভিন্ন সময় দেখা-সাক্ষাতের মাধ্যমে তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে এবং বিভিন্ন হোটেল রাত যাপন করেন। ইভা ও রাজু তাদের প্রতারণার ফাঁদে একে-অপরকে সহযোগিতা করতেন। রাজু বিভিন্ন প্রতারিত ব্যক্তির কাছে তানজিনা ইভাকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, গাজীপুর সদর সার্কেল বলে পরিচয় দিতেন। প্রতারক রাজুর হোয়াটসঅ্যাপ থেকে ইভাকে কল দিয়ে কথা বলিয়ে দিয়ে বিশ্বাস স্থাপন করতেন। প্রতারণায় অর্জিত টাকা দুজন ভাগবাটোয়ারা করে নিতেন।
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের ওয়েব বেউজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের ইনচার্জ এডিসি আশরাফউল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, প্রতারক রাজুর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ইভাকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় ইভার কাছ থেকে র্যাব, নেভি ও বিমান বাহিনী লেখা সম্বলিত আটটি ক্যাপ, ওয়াকিটকি সেট, ছয় লাখ ৭০ হাজার টাকা, তিনটি আইফোন, দুটি এটিএম কার্ড ও সিসা টানার সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। প্রাথমিকভাবে, ইভার ১০ বিয়ে ও শতাধিক লোককে প্রেমের ফাঁদে ফেলার তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানার পাঁচটি মামলা রয়েছে।
ডিবি কর্মকর্তা বলেন, অসংখ্য প্রতারিত ব্যক্তি প্রতারণাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করছে। যেসব ব্যক্তি, ব্যবসায়ী বা সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার প্রতারকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দফতরে প্রতিবেদন পাঠানো হবে।